দুপাশে সারি সারি গাছ। মধ্য দিয়ে চলে গেছে সড়ক। একপাশে ঘন অরণ্য আরেক পাশে নীল জলরাশির সমুদ্র মিলিয়ে এ রকম সড়কের অস্তিত্ব দেশের আর কোথাও নেই। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, গল্পটা কক্সবাজার-টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কের। প্রতিদিন দেশ-বিদেশের হাজারো পর্যটক এই প্রাকৃতিক আবেশ জড়ানো সড়ক ধরে ভ্রমণ করেন। সেই সড়ককে ছায়ায় মায়ায় শীতল করা সাড়ে ৬ হাজারের বেশি গাছ কিনা কাটা পড়বে? উন্নয়নের জন্য নিধন হবে এসব গাছ?
মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রশস্তকরণে ইতিমধ্যে এসব গাছ কাটার বিষয়ে সুপারিশ এসেছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের প্রশস্তকরণ প্রকল্পের আওতায় এসব গাছ কাটা পড়বে বলে বন বিভাগ জানিয়েছে। ইতিমধ্যে তারা মাঠ পর্যায়ে জরিপ করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি দিয়েছে। প্রথম ধাপে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই সড়কের কক্সবাজার শহরের কলাতলীর পর থেকে উখিয়ার পাটুরটেক পর্যন্ত ৩০.৪ কিলোমিটার রাস্তা প্রশস্ত করা হবে। এটির কাজ শুরুও হয়ে গেছে। কিন্তু পরিবেশবাদীদের ঘোর আপত্তি এতে।
এ বিষয়ে দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সারওয়ার আলম বলেন, ‘মাঠ পর্যায়ে সার্ভে করে আমরা একটি চিঠি দিয়েছি। মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পে ৬ হাজার ৬২৩টি গাছ কাটা পড়বে। আমরা এ বিষয়ে অনুমোদনের জন্য ঢাকায় বন বিভাগে চিঠি পাঠিয়েছি। তবে তারা এখনো অনুমোদন দেয়নি।’
উল্লেখ্য, এই প্রকল্প নিয়ে গত বছরের ২৭ নভেম্বর একটি সভা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন জেলা পরিবেশ ও বন উন্নয়ন কমিটির সভাপতি ও কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান। ওই সভায় কী পরিমাণ গাছ কাটা পড়বে, তার একটি তালিকা দেওয়া হয়। সেখানে দেখা যায়, কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের সড়ক প্রশস্ত হলে উভয় পাশে ৬ হাজার ৬২৩টি গাছ কাটা পড়বে। গাছ কাটার পর গোল কাঠের পরিমাণ হবে ৪৮ হাজার ৫৬২ ঘনফুট। বিভিন্ন প্রজাতির বল্লির সংখ্যা হবে ৯৭৫টি বা দৈর্ঘ্য ১২ হাজার ৯৩৮ ফুট। জ্বালানির পরিমাণ হবে ৩০ হাজার ৯৩৬ ফুট।
জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান আজকের পত্রিকাকে বলেন, উল্লিখিতসংখ্যক গাছ কাটা পড়বে বলে বন বিভাগ জানিয়েছিল। তবে গাছ কাটার বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহে আরেফীন আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রকল্পের কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পে ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে ভূমি অধিগ্রহণে এবং বাকি ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে রেজুখাল ব্রিজ এবং ছোট-বড় ব্রিজ নির্মাণসহ বিভিন্ন পয়েন্টে সমুদ্রের সুরক্ষায়।
এদিকে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘গাছ না কেটে সড়ক প্রশস্ত করা যায়। আমি অনেকবার মেরিন ড্রাইভে ঘুরতে গিয়েছি। এখানকার মূল আকর্ষণ কিন্তু সড়কের পাশে সারি সারি গাছ। এসব গাছ কেন কাটতে হবে। গরম গরম বলে চিৎকার করে এভাবে প্রকল্পের নামে গাছ কাটলে তো গরম বাড়বেই।’
সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্র জানায়, বর্তমানে মেরিন ড্রাইভের ১৮ ফুট থেকে সড়কটি ৩৪ ফুটে উন্নীত করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় রয়েছে ১১৩ দশমিক ২৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ, ৭ লাখ ২৪ হাজার ঘনমিটার মাটি ভরাট, ২৯ দশমিক ৪২ কিলোমিটার ফ্লেক্সিবল পেভমেন্ট প্রশস্তকরণ ও শূন্য দশমিক ৩২ কিলোমিটার ফ্লেক্সিবল পেভমেন্ট বাঁক সরলীকরণের কাজ।
এ ছাড়া ৬ হাজার ৪৮০ মিটার আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ, ৬৩ হাজার ৭২০ বর্গমিটার জিও টেক্সটাইলসহ সিসি ব্লক স্থাপন, ৫৪ হাজার ৩৬০টি টেট্রাপড নির্মাণ, ৯ হাজার ১২০ বর্গমিটার রোড মার্কিং, ইউটিলিটি স্থানান্তর, রেজুখালের ওপর দুই লেনের একটি সেতু নির্মাণ (৩০৫ মিটার) এবং মেরিন ড্রাইভের নিরাপত্তায় ৬০৮টি সিসি টিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে এই প্রকল্পের আওতায়। একই সঙ্গে ৯ হাজার ১৮০ মিটার এল ড্রেন ও ১৩ হাজার ৯৪ মিটার ইউ ড্রেনের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও নির্মাণ করা হবে।
২০২২ সালের ২৮ জুন প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। নিরাপদ যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলা, পর্যটনশিল্পের প্রসার এবং প্রকল্প এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন মাথায় রাখা হয়েছে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে।