ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন দৃশ্যত বিপর্যস্ত হওয়ার মুখে। নারীদের ব্যাপারে অশ্লীল ও কুৎসিত মন্তব্যসংবলিত একটি ভিডিওতে ট্রাম্পের বক্তব্যের কারণে তাঁর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর দাবি উঠেছে। পরে দুঃখ প্রকাশ করেও সমালোচনার ঝড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন রিপাবলিকান প্রার্থী।
২০০৫ সালে ধারণ করা তিন মিনিটের ওই ভিডিওতে ট্রাম্পকে বলতে দেখা যায়, সুন্দরী মেয়ে দেখলেই তাকে চুমু খেতে তিনি ব্যাকুল হয়ে পড়েন। ‘আমি সুন্দরী মেয়ে দেখলে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। একদম চুম্বকের মতো, বিন্দুমাত্র অপেক্ষা করি না। তুমি যদি “স্টার” হও, যা খুশি করতে পারো। মেয়েদের গায়ে হাত দিয়ে তাদের কাছে টানতে পারো।’
একজন বিবাহিত নারী প্রসঙ্গে ট্রাম্প বলেন, তাঁর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের বিস্তর চেষ্টা করেও তিনি সফল হননি।
এনবিসি টিভির জন্য একটি অনুষ্ঠান রেকর্ড করার জন্য ট্রাম্প বাসে করে আসছিলেন। তাঁকে স্বাগত জানাতে অপেক্ষা করছিল এক তরুণী। মেয়েটিকে দেখেই ট্রাম্প বলে ওঠেন, ‘দাঁড়াও, গোটা কয় টিকট্যাক (অতি ক্ষুদ্র লজেন্স) খেয়ে নিই। আবার যদি চুমু খেতে হয়।’
ভিডিওটি ধারণ করার সময় ডোনাল্ড ট্রাম্পের বয়স ছিল ৫৯। তিন সন্তানের জনক ট্রাম্প এর মাত্র কয়েক মাস আগে তৃতীয়বারের মতো বিয়ে করেছিলেন। ভিডিওটিতে স্ত্রীর কথা উল্লেখ করে তাঁকে বলতে শোনা যায়, মেলানিয়া তাঁর এই জাতীয় কাজকর্ম অনুমোদন করেন।
শুক্রবার বিকেলে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা এই ভিডিওটি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। তবে এটি কোথা থেকে পেয়েছে সে কথা তারা জানায়নি। প্রকাশ করার আগে ভিডিওটি নকল নয়, এ কথা নিশ্চিত করতে পত্রিকাটি তা ট্রাম্পের নির্বাচনী দপ্তরে পাঠায়। পোস্টের কাছে পাঠানো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প বলেন, অনেক বছর আগের এই কথোপকথন নিছক খেলোয়াড়দের পোশাক পরিবর্তন কক্ষের হাসি-তামাশাজাতীয় বিষয়। গলফ খেলার সময় (সাবেক প্রেসিডেন্ট) বিল ক্লিনটন তাঁকে এর চেয়ে অনেক বেশি অশালীন কথা বলেছেন। তিনি যোগ করেন, ‘এ জন্য কেউ যদি ক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন, তাহলে আমি ক্ষমা চাইছি।’
ভিডিওটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব মহল থেকে প্রবলভাবে সমালোচিত হতে থাকেন ট্রাম্প। রিপাবলিকান পার্টির প্রথম সারির নেতা ও কংগ্রেস সদস্যরা শুধু সমালোচনাই করেননি, কেউ কেউ ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট পদে সমর্থন করতেও অস্বীকার করেন। শনিবার উইসকনসিনে কংগ্রেসের স্পিকার পল রায়ানের সঙ্গে ট্রাম্পের এক সভায় অংশগ্রহণের কথা ছিল। ভিডিওটি প্রকাশের পর রায়ান এক বিবৃতিতে বলেন, ট্রাম্প তাঁর অনুষ্ঠানে আসছেন না।
ট্রাম্প নারীদের ব্যাপারে এর আগেও অশালীন মন্তব্য করেছেন। দুই সপ্তাহ আগে প্রথম বিতর্কে হিলারি ক্লিনটন নারীদের প্রতি ট্রাম্পের অশালীন মন্তব্যের বিভিন্ন উদাহরণ তুলে ধরেন। গত সোমবার অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) এক প্রতিবেদনে জানায়, ট্রাম্প নিজস্ব টিভি অনুষ্ঠান ‘অ্যাপ্রেন্টিস’ রেকর্ড করার সময় মেয়েদের দিকে আঙুল তুলে তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করতেন। শুক্রবার নিউইয়র্ক টাইমস-এর সুপরিচিত সাংবাদিক নিকোলাস ক্রিস্টস তাঁর কলামে ছয় বছর আগে ট্রাম্পের সঙ্গে ব্যবসায় আগ্রহী এক নারীর উদাহরণ তুলে ধরেন। ট্রাম্প তাঁর সঙ্গেও খোলামেলাভাবে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন।
অধিকাংশ ভাষ্যকারই নারীদের ব্যাপারে ট্রাম্পের এই আচরণকে ‘প্রিডেটরি’ বা লুণ্ঠনপরায়ণ বলে বর্ণনা করেছেন। নিউইয়র্ক টাইমস ‘ট্রাম্পের অশালীন ব্যবহার’ শিরোনামের এক সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করে, দেশের প্রেসিডেন্ট হতে হলে যে মূল্যবোধ ধারণ করা দরকার ট্রাম্পের ভেতর তা নেই। ‘আমরা আমাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় আশা করি, ব্যক্তিগত অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও, তাঁরা আমাদের মধ্যে যা কিছু ভালো, তার প্রতিনিধিত্ব করবেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে তেমন কিছুই আশা করা যায় না।’
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনও এক টুইটারবার্তায় ট্রাম্পের আচরণকে ‘ভীতিকর’ বলে বর্ণনা করেন। ‘এমন লোক কিছুতেই আমাদের প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না’, তিনি লেখেন।
ট্রাম্প দুঃখ প্রকাশ করে প্রথমে এক বাক্যের যে বিবৃতিটি প্রকাশ করেন, তাও সব মহলে সমালোচিত হয়। সে বিবৃতিতে তিনি বিল ক্লিনটনের কথা ব্যবহার করে নিজের দোষ এড়ানোর যে চেষ্টা করেন, তাও সব মহলে প্রত্যাখ্যাত হয়। নিউইয়র্ক টাইমস মন্তব্য করে, বিল ক্লিনটন সত্যি এমন কোনো কথা বলেছেন কি না, তা আমরা জানি না। আর বলে থাকলেও বিল ক্লিনটন তো প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করছেন না, ট্রাম্প করছেন।
চতুর্দিক থেকে প্রবলভাবে সমালোচিত হওয়ার পর প্রায় মধ্যরাতে ট্রাম্প একটি রেকর্ডকৃত ভিডিও বিবৃতি প্রকাশ করেন। এতে ট্রাম্প বলেন, তিনি কখনোই নিজেকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে দাবি করেননি। অনুতপ্ত হওয়ার মতো অনেক কথা বলেছেন, অনেক কাজ করেছেন। ‘যারা আমাকে চেনে, তারা জানে এসব কথার মধ্যে আমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু কথাগুলো আমি বলেছি। কথাগুলো ভুল ছিল, সে জন্য আমি ক্ষমা চাইছি।’
ট্রাম্প কখনোই কোনো ব্যাপারে ক্ষমা চাইতে অভ্যস্ত নন। ইতিপূর্বে খ্রিষ্টান হওয়া সত্ত্বেও তিনি ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন না বলে সদম্ভে জানিয়েছেন। নিন্দার ঝড়ের মুখে পড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে যে ভিডিওটি প্রকাশ করেন, তাতেও প্রকৃত দুঃখবোধের কোনো প্রকাশ নেই। টেলিপ্রম্পটারের দিকে তাকিয়ে, কিছুটা বিরক্ত হয়ে, যেন নিজের আপত্তি সত্ত্বেও কথাগুলো তিনি পড়ে শোনান। ট্রাম্প দাবি করেন, তাঁর মন্তব্য নিয়ে যে বিতর্ক উঠেছে তা দেশের সামনে উপস্থিত সমস্যা থেকে নজর ফেরানোর চেষ্টামাত্র।
নামমাত্র দুঃখ প্রকাশ করে ট্রাম্পের এই বিবৃতি সমালোচনার ঝড় সামলাতে পারবে বলে মনে হয় না। এ ছাড়া সংকট শুধু তাঁর একার নয়, পুরো রিপাবলিকান পার্টির জন্য। এই বিতর্কের ফলে সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচনে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
রিপাবলিকান পার্টির শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব নেতাই ট্রাম্পের অশ্লীল কথা ও আচরণের তীব্র নিন্দা করেছেন। সমর্থন প্রত্যাহার ছাড়াও কেউ কেউ দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে ট্রাম্পকে সরে দাঁড়ানোর দাবি পর্যন্ত করছেন। এঁদের অন্যতম ইউটাহ থেকে নির্বাচিত রক্ষণশীল সিনেটর মাইক লি ট্রাম্পকে প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ করেছেন। এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেছেন, ‘আমাদের মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করে, এমন কাউকে আমাদের পতাকা বহনের সুযোগ দিন।’
ট্রাম্প নিজে অবশ্য সরে দাঁড়ানোর কোনো ইঙ্গিত দেননি। বরং জানিয়েছেন, রোববার রাতে (বাংলাদেশে সোমবার সকাল) হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে দ্বিতীয় বিতর্কের জন্য জোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।
‘কিছুতেই সরে দাঁড়াব না’: ট্রাম্প গতকাল শনিবার ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকাকে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়ে দিয়েছেন, নির্বাচনী লড়াই থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা তিনি কোনোভাবেই ভাবছেন না। তিনি বলেন, ‘আমি কিছুতেই সরে দাঁড়াব না। জীবনে কখনো আমি কোনো কিছুতে সরে দাঁড়াইনি। না, আমি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছি না। আমার বিপুল জনসমর্থন রয়েছে।’
ট্রাম্পের রানিং মেট মাইক পেন্স বলেছেন, ভিডিওতে ট্রাম্পের কথা শুনে তিনি খুবই মর্মাহত। তবে এটা ভালো যে ট্রাম্প অনুতাপ প্রকাশ করেছেন এবং দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।
হিলারির বক্তব্য ফাঁস: বিবিসি জানায়, হিলারির দেওয়া বিভিন্ন একান্ত বক্তব্যের পূর্ণ বিবরণী ফাঁস করেছে উইকিলিকস। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেওয়া ওই সব বক্তব্যের অনুলিপি প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন হিলারি।
ফাঁস হওয়া নথি অনুযায়ী, ২০১৩ সালের অক্টোবরে গোল্ডম্যান স্যাক্স ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে হিলারি বলেছিলেন, আর্থিক খাতের সংস্কারের জন্য ওয়ালস্ট্রিটের সঙ্গে পরামর্শ করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
এ ছাড়া একই বছর ব্রাজিলের একটি ব্যাংকের অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে হিলারি বলেন, তিনি মুক্তবাণ্যিজ্য ও মুক্ত সীমান্তের স্বপ্ন দেখেন।
সমালোচকদের কেউ কেউ হিলারিকে ওয়ালস্ট্রিটের দালাল বলে অভিহিত করে থাকেন।
পাঠকের মতামত