প্রকাশিত: ১৩/০৯/২০১৬ ৬:২২ এএম

কোরবানি মুসলিম উম্মাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত।  যাদের ওপর জাকাত ওয়াজিব, তাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব। কোরবানির মাধ্যমে গরিব-দুঃখী ও পাড়া-প্রতিবেশীর আপ্যায়নের ব্যবস্থা হয়।

যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব 
প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন মুসলিম নর-নারী, যে কোরবানির দিনগুলোতে সাড়ে সাত ভরি সোনা, সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা বা ওই পরিমাণ রুপার সমমূল্যের নগদ অর্থ অথবা বর্তমানে বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজনে আসে না এমন জমি, প্রয়োজনাতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও প্রয়োজনাতিরিক্ত অন্য আসবাবপত্রের মালিক হবে, তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে। (মাবসুতে সারাখসি ১২/৮, রদ্দুল মুহতার : ৬/৬৫)

আর সোনা বা রুপা কিংবা টাকাপয়সা—এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নিসাব পরিমাণ না থাকে, কিন্তু প্রয়োজনাতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার সমমূল্যের হয়ে যায়, তাহলেও তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। যেমন কারো কাছে কিছু স্বর্ণ ও কিছু টাকা আছে, যা সর্বমোট সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার মূল্যের সমান, তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। (রদ্দুল মুহতার : ৫/২১৯)

কোরবানির নিসাব পূর্ণ হওয়ার জন্য জাকাতের মতো সম্পদের বর্ষ অতিক্রম হওয়া শর্ত নয়, শুধু কোরবানির তিন দিন (জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ) নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়াই যথেষ্ট। এমনকি ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বক্ষণেও নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়ে গেলে কোরবানি ওয়াজিব হবে। (বাদায়েউস সানায়ে : ৫/৬২) একান্নভুক্ত পরিবারের মধ্যে একাধিক ব্যক্তির কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে তাদের প্রত্যেকের ওপর ভিন্ন ভিন্ন কোরবানি ওয়াজিব। (কিফায়াতুল মুফতি : ৮/১৭৮)

শরিকে কোরবানি করা 
শরিকে কোরবানি করলে গোশত ওজন করে বণ্টন করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা জায়েজ নেই। তবে হাড্ডি-মাথা ইত্যাদি যেসব অংশ সাধারণত সমানভাবে ভাগ করা যায় না, সেগুলো অনুমান করে ভাগ করা যাবে। (ফাতাওয়া কাজিখান : ৩/৩৫১)

শরিকি কোরবানিতে কোনো অংশীদার আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য নিয়ত (যেমন গোশত খাওয়ার নিয়ত) করলে শরিকদের কারো কোরবানি শুদ্ধ হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে শরিক নির্বাচন করা জরুরি। (আল বাহরুর রায়েক : ৮/২০২)

পশু জবাই করার বিধান 
ঈদের নামাজের আগে কোরবানি করা জায়েজ নেই। কেউ ঈদের নামাজের আগে কোরবানি করলে পুনরায় কোরবানি করা ওয়াজিব। (জাওয়াহিরুল ফিকহ : ১/৪৪৯)

নিজের কোরবানি নিজ হাতে জবেহ করা উত্তম। নিজে না পারলে অন্যকে দিয়ে জবেহ করে নেবে। সে ক্ষেত্রে জবেহর সময় পশুর কাছে থাকা উত্তম। (শামি : ৬/৩২৮)

জবেহ করার সময় জবেহকারীর মুখ কেবলার দিকে ফিরিয়ে রাখা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। অকারণে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখা মাকরুহে তাহরিমি। (আলমগিরি : ৫/২৮৮)

জবাইয়ে পশুর চারটি রগের (শ্বাসনালি, খাদ্যনালি ও দুটি রক্তনালি) মধ্য থেকে যেকোনো তিনটি কাটা আবশ্যক। চারটি কাটাই উত্তম। (আল বাহরুর রায়েক : ৮/১৯৩)

জবাইকারী ও তার সঙ্গে ছুরি ধরায় অংশগ্রহণকারী উভয়েই ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করতে হবে। ইচ্ছাকৃত কেউ ‘বিসমিল্লাহ’ ছেড়ে দিলে পশু হালাল হবে না। তবে ভুলবশত হলে কোনো সমস্যা নেই। (আল বাহরুর রায়েক : ৮/১৯৩)

কোনো কোনো সময় জবাইকারীর জবাই সম্পন্ন হয় না, তখন কসাই বা অন্য কেউ জবাই সম্পন্ন করে থাকে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই উভয়কেই নিজ নিজ জবাইয়ের আগে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ পড়তে হবে। যদি কোনো একজন না পড়ে, তবে জবাইকৃত পশু হালাল হবে না। ওই কোরবানিও শুদ্ধ হবে না। (রদ্দুল মুহতার : ৬/৩৩৪)

জবাইয়ের সময় কোরবানির জন্তুকে কেবলার দিকে ফিরিয়ে শায়িত করার পর এ দোয়া পড়বে—‘ইন্নি ওজ্জাহতু ওজহিয়া লিল্লাজি ফাত্বারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা হানিফাও ওয়ামা আনা মিনাল মুশরিকিন। ইন্না সলাতি ওয়া নুসুক্বি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতী লিল্লাহি রব্বিল আলামিন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২৭৯৫)

তারপর ‘বিসমিল্লাহ’ বলে জবাইয়ের কাজ সমাধা করবে। জবাইয়ের কাজ সমাধা করে এ দোয়া পড়বে—‘আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল মিন্নি কামা তাকাব্বালতা মিন হাবীবিকা মুহাম্মদ ওয়া খলীলিকা ইব্রাহীম (আ.)।’

অনেকে কোরবানি করার জন্য দোয়া পড়াকে জরুরি মনে করেন। অথচ দোয়া পড়া ছাড়াও কোরবানি বৈধ। দোয়া পড়া মুস্তাহাব। কোরবানি করার সময় লিস্ট করে শরিকদের নাম পাঠ করা জরুরি নয়। অন্তরে নিয়ত করলেই কোরবানি হয়ে যাবে।

জবাইয়ের পর পশু নিস্তেজ হওয়ার আগে চামড়া খসানো বা কোনো অঙ্গ কাটা মাকরুহ। জবাইয়ের সময় প্রাণীকে কষ্ট কম দেওয়ার চেষ্টা করবে। অন্য পশুর সামনে জবাই করবে না। (বাদায়েউস সানায়ে : ৫/৮০)

কোরবানির পশু জবাই করে পারিশ্রমিক দেওয়া-নেওয়া জায়েজ। তবে পশুর কোনো অংশ পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া যাবে না। (কিফায়াতুল মুফতি : ৮/২৬৫)

পশুতে অংশীদার কেউ জবাই করে অন্য শরিকদের থেকে জবাইয়ের পারিশ্রমিক নেওয়া জায়েজ নেই। (আহসানুল ফাতাওয়া : ৭/৫১৮)
জবেহ করার সময় পশুর মাথা যদি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে তা হারাম হবে না। হালালই থাকবে। কোরবানিও আদায় হয়ে যাবে। (রদ্দুল মুহতার : ৫/১৮৮)

কোরবানির গোশতের বিধান 
কোরবানির গোশতের এক-তৃতীয়াংশ গরিব-মিসকিনকে এবং এক-তৃতীয়াংশ আত্মীয়স্বজন ও পাড়াপ্রতিবেশীকে দেওয়া উত্তম। অবশ্য পুরো গোশত নিজে রেখে দিলেও কোনো অসুবিধা নেই। (বাদায়েউস সানায়ে : ৫/৮১)

মানতকৃত কোরবানির গোশত নিজে ও পরিবার-পরিজন খেতে পারবে না। তা কোনো দরিদ্র মুসলমানকে সদকা করে দেওয়া ওয়াজিব। (রদ্দুল মুহতার : ৬/৩২১)

জবাইকারী, কসাই বা কাজে সহযোগিতাকারীকে চামড়া, গোশত বা কোরবানির পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া জায়েজ নেই। অবশ্য পূর্ণ পারিশ্রমিক দেওয়ার পর পূর্ব চুক্তি ছাড়া হাদিয়া হিসেবে গোশত বা তরকারি দেওয়া যাবে। (আল বাহরুর রায়েক : ৮/২০৩)

পশুর যেসব অঙ্গ খাওয়া জায়েজ নেই, তা হলো—জমাট বাঁধা গোশত, যোনি-পুরুষাঙ্গ, মলধার, সাদা রগ, অণ্ডকোষ, মূত্রথলি, পিত্ত ও প্রবহমান রক্ত। (শামি : ৬/৭৪৯)

কোরবানির গোশত অমুসলিমদেরও দেওয়া যায়। (হেদায়া : ৪/৪৫)

কোরবানির পশুর অংশ ক্রয়-বিক্রয়
কোরবানির পশুর কোনো অংশ যেমন—গোশত, চর্বি, হাড্ডি ইত্যাদি বিক্রি করা জায়েজ নয়। বিক্রি করলে পূর্ণ মূল্য সদকা করে দিতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে : ৫/৮১)

পশুর চামড়া কোরবানিদাতা নিজেও ব্যবহার করতে পারবে। তবে কেউ যদি নিজে ব্যবহার না করে বিক্রি করে, তবে বিক্রিলব্ধ মূল্য সদকা করা জরুরি। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৫/৩০১)

পশুর দেহ থেকে চামড়া পৃথক করার আগে তা বিক্রি করা নাজায়েজ। (দুররে মুখতার : ৬/৩২৯)

কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করলে মূল্য সদকা করে দেওয়ার নিয়তে বিক্রি করবে। বিক্রিলব্ধ অর্থ পুরোটাই জাকাতের উপযুক্ত ব্যক্তিকে সদকা করে মালিক বানিয়ে দেওয়া জরুরি। তা মাদ্রাসা-মসজিদ ইত্যাদি নির্মাণে খরচ করা জায়েজ নয়। তবে তা লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের জন্য দেওয়া যাবে। (ফাতাওয়া কাজিখান : ৩/৩৫৪)

কোরবানির চামড়ার মূল্য দিয়ে ইমাম, খতিব, মুয়াজ্জিন, শিক্ষক ও কর্মচারীর বেতন দেওয়া নাজায়েজ। (শামি : ২/৩৩৯)

– মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ, শিক্ষক, মাদ্রাসাতুল মদিনা, নবাবপুর, ঢাকা।

পাঠকের মতামত

তুরস্কে কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম হলেন বাংলাদেশি হাফেজ

ইসলামী ঐতিহ্যের স্মৃতি বিজড়িত তুরস্কে অনুষ্ঠিত ৯ম আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম হলেন বাংলাদেশি হাফেজ, ...