অসুস্থ তরুণীকে রক্ত দিতে এগিয়ে এলেন এক যুবক। অনেকটা জীবন উপহার দিলেন ওই তরুণীকে। জয় করে নিলেন তরুণীর মন। শুরু হলো প্রেমের সম্পর্ক।’
শুরুর বর্ণনায় তই ফিল্মি শব্দটি অনায়াসে জুড়ে দেয়া যায়। কিন্তু এত চমৎকার শুরুর শেষটা এত জঘন্য হবে কেউ-ই হয়তো চিন্তা করতে পারেনি। চিন্তা করতে পারেনি সেমন্তি নামের সেই তরুণীও।
গত ১৭ জুন রাতে সেমন্তির আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে সম্পর্কটির সমাপ্তি ঘটে। এর আগে ফাঁদে ফেলে সেমন্তিকে ধর্ষণ করেছে যুবক আবির; এমনই অভিযোগ সেমন্তির বাবার।
সেমন্তির বাবার দেয়া তথ্যমতে, গত ১৭ জুন রাত আড়াইটা পর্যন্ত আবির ও সেমন্তি ফোনে ও ম্যাসেঞ্জারে কথা বলেছে। সেখানে সেমন্তি বার বার আবিরকে অনুরোধ করেছে, তাদের অনৈতিক সম্পর্কের কথা ফাঁস না করতে। কিন্তু উত্তরে আবির বলেছে, ‘ব্যবহার করা জিনিস আর নেই না’...। শহরের জলেশ্বরীতলা এলাকার ব্যবসায়ী হাসানুল মাশরেক রুমের মেয়ে মায়িশা ফাহমিদা সেমন্তি বগুড়া ওয়াইএমসিএ স্কুল ও কলেজে দশম শ্রেণিতে পড়তো। আর ওই এলাকার বাসিন্দা তৌহিদুল ইসলামের ছেলে আবির আহমেদ এইসএসসি পাশ করে ঢাকায় একটি প্রাইভেট কোচিংয়ে পড়াশোনা করছে।
গত ১৭ জুন রাতের কোনো এক সময় নিজের শোবার ঘরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। এর আগে ওই স্কুলছাত্রী মায়িশা ফাহমিদা সেমন্তির আত্মহত্যায় রহস্য পুলিশি অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
অনুসন্ধান সূত্র বলছে, কথিত ‘প্রেমিক’ কলেজছাত্র আবির আহমেদ ব্ল্যাকমেইল করে গত আট মাস ধরে ধর্ষণ করে। এ দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার ও অবহেলা করায় সেমন্তি গত ১৭ জুন রাতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সেমন্তির বাবা হাসানুল মাশরেক রুমন অভিযোগ করেন, এক নারীসহ আবিরের সাত সদস্যের একটি গ্রুপ আছে। সাদিয়া রহমান নামে ওই নারী সদস্যের মাধ্যমে মেয়ে সংগ্রহ করে আবির। ওই গ্রুপের সদস্যরা মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করে থাকে। মেয়ে সেমন্তির মোবাইল ফোনের মেমোরি কার্ড থেকে শনিবার সকালে এসব তথ্য পেয়েছেন। এর পরপরই তথ্যগুলো বগুড়ার এসপিসহ বিভিন্ন দফতরে সরবরাহ করেছেন তিনি।
গত ১৭ জুন রাতে সেমন্তির আত্মহত্যার পরদিন সকালে এ ঘটনা টের পায় তার বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যরা। এতে শোকে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। ময়নাতদন্ত শেষে সেমন্তির লাশ দাফনের পর সদর থানায় অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা হয়।
এদিকে সেমন্তির বাবা রুমন মেয়ের মৃত্যু রহস্য উদঘাটনে তৎপর হন। তিনি জানতে পারেন এর নেপথ্যে একই এলাকার বাসিন্দা তৌহিদুল ইসলামের ছেলে আবির আহমেদ এর নেপথ্যে রয়েছে। তার ধারণা হয়, সেমন্তি বন্ধুর ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার। তিনি গত ২৫ জুন মেয়ের ফেসবুক আইডি, সিমসহ মোবাইল ফোন, মেয়ের বন্ধু আবির ও শাহরিয়ার অন্তরের ফোন নম্বর ও তাদের ফেসবুক এবং ম্যাসেঞ্জারে কথোপকথনের বিবরণসহ সদর থানায় মামলা দায়ের করেন। কিন্তু আবির পুলিশ পরিবারের সন্তান হওয়ায় সদর থানা বিষয়টি নিয়ে টালবাহানা শুরু করে।
হতাশ বাবা রুমন গত ২৭ জুন থেকে নিজের ফেসবুক আইডিতে মৃত মেয়ের ছবিসহ ফেসবুকে হৃদয়স্পর্শী পোস্ট দেন। ফলে ঘটনাটি ফেসবুকে ভাইরাল হলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরে আসে। গত ৪ জুলাই রাতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেমন্তির বাবা রুমকে ডেকে পাঠান। তার কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য, সেমন্তির মোবাইল ফোন ও সিম উদ্ধার করেন। এছাড়া নতুন করে মামলার কাগজ নিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাসও দেয়া হয়।
শনিবার সকালে সেমন্তির বাবা রুমন জানান, তিনি শুক্রবার রাতভর সেমন্তির মোবাইল ফোনের মেমোরি কার্ডের মুছে ফেলা তথ্যগুলো উদঘাটন করেন। সেখানে তিনি তার মেয়ের আত্মহত্যার কারণ ও এর নেপথ্যে কে কে আছে- তা জানতে পারেন।
রুমন বলেন, প্রায় ১৫ মাস আগে তার ছোট মেয়ে অসুস্থ হয়। তখন প্রতিবেশী তৌহিদুল ইসলামের ছেলে আবির রক্ত দেয়। এতে দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। এরপর সেমন্তি ও আবিরের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। একপর্যায়ে আবিরের ফাঁদে পড়ে সেমন্তি। প্রতারক আবির গত আট মাস সেমন্তিকে ধর্ষণ করেছে। এ চিত্র বন্ধুদের কাছে শেয়ার করেছে। সেমন্তি এসব চাপা দিতে নানা অজুহাতে মায়ের কাছে মাঝে মাঝেই মোটা অংকের টাকা নিতে থাকে।
তিনি বলেন, গত ১৭ জুন রাত আড়াইটা পর্যন্ত আবির ও সেমন্তি ফোনে ও ম্যাসেঞ্জারে কথা বলেছে। সেখানে সেমন্তি বার বার আবিরকে অনুরোধ করেছে, তাদের অনৈতিক সম্পর্কের কথা ফাঁস না করতে। কিন্তু উত্তরে আবির বলেছে, ‘ব্যবহার করা জিনিস আর নেই না’...।
রুমন আরো জানান, গত ১৭ জুন রাত ১টা পর্যন্ত সেমন্তি তার কাছে ছিল। সে বলেছিল তাকে কেউ ব্লাকমেইল করলে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে কী? তখন রুমন মেয়েকে আশ্বাসও দিয়েছিলেন। কিন্তু সেমন্তি সে আশ্বাসে ভরসা রাখতে পারেনি। এছাড়া আবির ফোনে তাকে (রুমন) সতর্ক করেছিল, সেমন্তি আত্মহত্যা করতে পারে। রাতের কোনো এক সময় সেমন্তি ঘরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে।
রুমন বলেন, আবিরকে সন্দেহ করে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে সদর থানা পুলিশের কাছে মামলা দায়ের করি। কিন্তু আবিরের প্রভাবশালী বাবা-চাচার চাপে পুলিশ এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছে। আবির বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর বর্তমানে ঢাকায় কোচিং করছে।
রুমন এসব তথ্য উদঘাটনের পর তার মেয়ের আত্মহত্যায় জড়িত আবির ও অন্যদের বিচার প্রত্যাশা করে শনিবার সকালে বগুড়ার পুলিশ, দুদকের মহাপরিচালকসহ বিভিন্ন দফতর প্রধানের কাছে পাঠিয়েছেন।
বগুড়া সদর থানার ওসি এসএম বদিউজ্জামান ও তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সুমন কুমার জানান, মামলা করতে হলে এজাহারে আসামির নাম উল্লেখ থাকতে হয়। সেমন্তির বাবার দু’বার দেয়া অভিযোগের তদন্ত চলছে। এছাড়া মোবাইল ফোনের কললিস্ট চেয়ে কোম্পানিতে আবেদন ও উদ্ধার হওয়া ফোন ঢাকার সাইবার ইউনিটে পাঠানোর জন্য আদালতে আবেদন করা হয়েছে।
বগুড়া সদর সার্কেলের অতিরিক্ত এসপি (মিডিয়া) সনাতন চক্রবর্তী জানান, সেমন্তির বাবা প্রথমে শাহরিয়ার অন্তর নামে একজনের নাম বলেছিলেন; তিনদিন পর আবিরের নাম বলেছেন। পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশনা আছে, আত্মহত্যার সহযোগিতার মামলা নিতে হলে প্রত্যক্ষ প্রমাণ থাকতে হবে। আসলে এ ব্যাপারে তদন্তে কিছু পাওয়া যাবে না।
এ ব্যাপারে বক্তব্য পেতে শনিবার দুপুরে আবির আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার দুটি মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। আবিরের বাবা তৌহিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তাকেও পাওয়া যায়নি।