কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধ বিহার ও বসতিতে হামলার চার বছরেও আইনি কার্যক্রম নিয়ে অসন্তোষ কাটেনি ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। পুনর্বাসন নিয়ে সন্তুষ্টি দেখালেও প্রকৃত অপরাধীদের বেশিরভাগ আইনের আওতায় না আসায় শঙ্কা কাটছে না তাদের। এ অবস্থায় সুষ্ঠু বিচারের পাশাপাশি হারানো সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনার উপর জোর দিচ্ছেন ধর্মীয় নেতারা। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতারা বলছেন, বৌদ্ধ বিহার ও বসতিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় যে মামলাগুলো হয়েছে, এ বিষয়ে কিছুই জানে না বৌদ্ধ সম্প্রদায়। কাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, কাকে বাদ দেওয়া হয়েছে- পুরো বিষয়টি নিয়ে তারা অন্ধকারে রয়েছেন।
প্রসঙ্গত: উত্তম বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকে পবিত্র কোরআন শরীফ অবমাননার অভিযোগ এনে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর ১২টি বৌদ্ধ বিহার, ২৬টি বসতঘরে অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় আরো ছয়টি বৌদ্ধ বিহার এবং শতাধিক বসতঘরে হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয়। পরদিন (৩০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে উখিয়ায় আরো চারটি বৌদ্ধ বিহারে হামলা চালানো হয়েছে। জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রামু, উখিয়া ও টেকনাফে সহিংসতার ঘটনায় ১৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রামু থানায় ৮টি, উখিয়ায় ৭টি, টেকনাফে দুইটি ও কক্সবাজার সদর থানায় দুইটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে ১৫ হাজার ১৮২ জনকে। এজাহারভুক্ত আসামি করা হয় ৩৭৫ জনকে। পরবর্তীতে এসব মামলায় ৯৪৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। এর মধ্যে রামুর ৮টি মামলায় ৪৫৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। কক্সবাজার কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক রঞ্জিত পালিত জানান, ১৯টি মামলার মধ্যে জনৈক সুধাংশু বড়ুয়ার দায়ের করা মামলাটি আপোষ-মীমাংসামূলে নিষ্পত্তি করা হয়েছে। বাকি মামলার মধ্যে তিনটি মামলা অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআইকে দেওয়া হয়েছে। বাকি মামলাগুলো বিচারাধীন রয়েছে।
পিবিআই কক্সবাজারের পরিদর্শক জাবেদুল ইসলাম ও কৈশানু মার্মা জানান, কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের উখিয়ারঘোনা জেতবন বৌদ্ধ বিহার, লট উখিয়ারঘোনা জাদীপাড়া আর্য্যবংশ বৌদ্ধ বিহার, ফতেখাঁরকুলের লালচিং, সাদাচিং ও মৈত্রী বিহার এবং চাকমারকুল ইউনিয়নেরর অজান্তা বৌদ্ধ বিহারে হামলার ঘটনায় রুজু হওয়া তিনটি মামলা আদালত থেকে অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআই-এর কাছে পাঠানো হয়েছে। ইতিমধ্যে তদন্তকাজ শেষ করে জেতবন বৌদ্ধ বিহার, লট উখিয়ারঘোনা জাদীপাড়া আর্য্যবংশ বৌদ্ধ বিহারের মামলাটি অভিযোগপত্রও পুনরায় আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। তারা জানান, এ মামলায় প্রথমে ৭০জনকে অভিযুক্ত করে পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। অধিকতর তদন্ত শেষে এ মামলায় অভিযুক্তের তালিকায় নতুন আরো ২৬ জনসহ ১০৬জনকে অভিযুক্ত করে সম্প্রতি আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মমতাজ উদ্দিন বলেন, ‘মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রম অনেকটা শেষ পর্যায়ে। তবে এসব মামলায় সাক্ষী যারা, তারা বেশিরভাগই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। ভয়ে তাদের কেউ সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেন না। একটি মামলায় ১২ কি ১৩ জন আদালতে সাক্ষ্য দিলেও এদের মধ্যে ৯জন সাক্ষীকে বৈরি ঘোষণা করেছেন আদালত। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং ভুক্তভোগী যারা তারা যদি সাক্ষ্য না দেন, তাহলে অপরাধীরা পার পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়।’ তিনি জানান, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অনেকের সঙ্গে আমি যোগাযোগ করেছি, তারা কোনো ধরনের সহযোগিতা করছেন না। সবদিক বিবেচনা করেই তিনটি মামলা পুনঃ এবং অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআই-এর কাছে পাঠানো হয়েছে। আরো দু’টি মামলা অধিকতর তদন্তের জন্য প্রক্রিয়াধীন আছে। রামু উপজেলা কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ ঐক্য ও কল্যাণ পরিষদ ও রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের সাধারণ সম্পাদক তরুণ বড়ুয়া বলেন, ১৯টি মামলার বাদি পুলিশ। পুলিশ ইচ্ছেমত আসামি করেছে। ইচ্ছেমত বাদ দিয়েছে। এমনকি সেদিনের হামলায় যারা মিছিলের সামনের সারিতে ছিল, যারা ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দিয়েছে এরা কেউই পুলিশের অভিযোগপত্রে নেই। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে পুলিশকে বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও অভিযোগপত্রে প্রকৃত অপরাধীদের অনেকের নাম আসেনি। ফলে আইনগত পুরো বিষয়টি নিয়ে অন্ধকারে আছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়। এ অবস্থায় বর্তমানে ভয়ে সাক্ষীরাও সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেন না। সবমিলে মামলাগুলোর হ-য-ব-র-ল অবস্থা।
তিনি বলেন, ঘটনার পর থেকে সরকার এবং সেনাবাহিনীর কাছ থেকে অনেক সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। নতুন নতুন বৌদ্ধ বিহার ও বাড়ি ঘর নির্মাণসহ পুনর্বাসনের বিষয় নিয়ে সরকারের প্রতি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। বর্তমানেও সরকারের পক্ষ থেকে নানা সহযোগিতা অব্যাহত আছে। কিন্তু প্রকৃত অপরাধীদের অনেকেই আইনের আওতায় না আসায় অসন্তোষ কাটছে না বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের আবাসিক পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, এই চার বছরে আমরা ভাঙ্গা-গড়া, উত্থান পতন অনেক কিছুর মুখোমুখি হয়েছি। এ ঘটনায় রামুর হাজার বছরের গর্বের ধন ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে’ যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছিল এ চার বছরে তা অনেকটা কেটে উঠেছে। তবে এ অবস্থায় সুষ্ঠু বিচারের পাশাপাশি সম্প্রীতির জায়গাটাকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করতে হবে। সেটি হতে পারে সামাজিক ভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে বা আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।
সহিংসতা স্মরণে কর্মসূচি : এদিকে বিভীষিকাময় রামু সহিংসতার চার বছর অতিক্রান্তে রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদ শ্রীকুল লাল চিং-মৈত্রী কমপ্লেক্স চত্বরে দিনব্যাপী কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে সকাল ৮টায় জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ১০টায় সংঘদান ও অষ্ট উপকরণ দানসভা, বেলা বারটায় অতিথি ভোজন, দুপুর ২টায় মৈত্রীর্যালি, ৩টায় ধর্মসভা এবং বিকাল ৫টায় দেশ ও বিশ্বশান্তি কামনায় হাজার প্রদীপ প্রজ্বলন ও সমবেত প্রার্থনা। স্মরণানুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন বাংলাদেশি বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু দ্বাদশ সংঘরাজ ড. ধর্মসেন মহাথের। সভাপতিত্ব করবেন একুশে পদক প্রাপ্ত রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ, উপসংঘরাজ পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের।