রাজশাহীর হিমাগারগুলোতে আলু সংরক্ষণের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে রাস্তায় আলু ফেলে বিক্ষোভ করেছেন কৃষকরা
রাজশাহীর হিমাগারগুলোতে আলু সংরক্ষণের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে রাস্তায় আলু ফেলে বিক্ষোভ করেছেন কৃষকরা
রাজশাহীর হিমাগারগুলোতে আলু সংরক্ষণের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে রাস্তায় আলু ফেলে বিক্ষোভ করেছেন কৃষকরা। এ সময় অনেকে সড়কের ওপর শুয়ে পড়েন। কান্না করেছেন কেউ কেউ।
রবিবার (০২ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১টার দিকে রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলা পরিষদ চত্বরে এ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়। সেখানে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কে মোহনপুর উপজেলা সদর এলাকায় আলু ফেলে বিক্ষোভ করেন কৃষকরা।
কৃষকরা জানান, প্রতি কেজি আলু সংরক্ষণের জন্য আগে হিমাগারগুলোকে চার টাকা ভাড়া দিতে হতো। এবার তা বৃদ্ধি করে আট টাকা করা হয়েছে। ভাড়া দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই দ্রুত আগের ভাড়া নির্ধারণের দাবি জানান। তিন দিনের মধ্যে এই দাবি না মানা হলে কঠোর আন্দোলনের পাশাপাশি মহাসড়ক অবরোধের হুমকি দেন কৃষকরা। তাদের এই কর্মসূচির সঙ্গে স্থানীয় জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির নেতাকর্মীরা একাত্মতা ঘোষণা করেন।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন মোহনপুর উপজেলা জামায়াতের আমির জি এম আব্দুল আউয়াল, প্রধান অতিথি ছিলেন উপজেলা বিএনপির সভাপতি শামিমুল ইসলাম এবং প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য দেন সাধারণ সম্পাদক মাহবুবার রশিদ, বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন তানোর পৌরসভার সাবেক মেয়র বিএনপি নেতা মিজানুর রহমান।
শামিমুল ইসলাম বলেন, মাত্র কয়েক দিন আগে দেশ দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীন হয়েছে, এরই মধ্যে কৃষকদের রাস্তায় নামতে হয়েছে, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। আজকে আমরা এই সমাবেশ থেকে উপদেষ্টাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই যে আমরা রাজশাহী থেকে এত পরিমাণ আলু দেবো, আপনারা ভারতে রফতানি করুন। দাবি মানার জন্য কৃষকরা ৭২ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন। আমি বলবো, এই সামান্য দাবি মানার জন্য ৭২ ঘণ্টার প্রয়োজন পড়ে না, শুধু আগের ভাড়া কার্যকর করলেই মিটে যায়। আমি আজকে প্রশাসনের মাধ্যমে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই দাবি মানার অনুরোধ জানাচ্ছি।
জামায়াতের আমির জি এম আব্দুল আউয়াল বলেন, প্রশাসন মাত্র কয়েকজন কোল্ডস্টোরেজের মালিকের পক্ষে অবস্থান নিয়ে চুপ করে আছে। কয়েকটি কোল্ডস্টোরেজ আগে না সারা দেশের কৃষক আগে। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছে; কিন্তু এখনও মনে হচ্ছে তাদের দোসররা প্রশাসনে রয়ে গেছে। তারাই কোল্ডস্টোরেজের মালিকের স্বার্থ সংরক্ষণ করছে। কৃষকদের দাবি খুব সামান্য দাবি। এটা তো সবার কথা, কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে।
সমাবেশে মোহনপুরসহ তানোর ও পবা উপজেলার সহস্রাধিক কৃষক অংশ নেন। মোহনপুরের আলুচাষি লুৎফর রহমান হিমাগারমালিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা কৃষক প্রয়োজনে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেবো, তবু আপনাদের অন্যায় দাবি মেনে নেবো না। কোনও বিশৃঙ্খলা হলে এর দায়দায়িত্ব আপনাদের বহন করতে হবে। আপনারা মনে করবেন না যে আপনারা টাকা দিয়ে একটি পক্ষকে কিনে নেবেন আর এর বলির শিকার হবে দেশের ৮০ ভাগ গরিব কৃষক। আপনাদের টাকা আপনাদের অ্যাকাউন্টে রাখুন। ওই টাকার দিকে আমাদের নজর নাই, কিন্তু আপনারা কেন কোটিপতি হয়ে এই গরিব চাষির কষ্টের টাকার দিকে ভিক্ষুকের মতো হাত বাড়াচ্ছেন, এর জবাব আপনাদের দিতে হবে।’
আলুচাষি ইমরান আলী বলেন, ‘আমরা এত দিন হিমাগারে ৯০ থেকে ৯৫ কেজি পর্যন্ত এক বস্তায় আলু রেখেছি। আমাদের কাছ থেকে যারা ৩৪০ টাকা করে নিয়েছে, তাদের নির্দেশক্রমেই আমরা আবার এক বস্তায় ৭০ কেজি আলু রাখি। আমরা ভাড়া দিই ৩৪০ টাকা বস্তা হিসেবে। সেখান থেকে আবার যে যে রকম আলু রাখি, সেই পরিমাণ হিসেবে আমাদের কমিশন আকারে কিছু টাকা ফেরত দেয়। এর আগে পেইড বুকিংয়ের সময় আমরা ১৭০ টাকা দিতাম। তাদের আইন অনুযায়ী কেউ ২১০, কেউ ২২০ টাকা দিয়েছি। তারা তো তখন বলে নাই যে এবার বস্তায় ৫০ কেজি বেশি আলু রাখা যাবে না। আর আলুর কেজি পড়বে আট টাকা করে। হঠাৎ করে ওরা বলছে যে এক বস্তায় ৫০ কেজির বেশি আলু রাখা যাবে না। আর কেজিপ্রতি আলুর ভাড়া পড়বে আট টাকা। তারা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কোনও কথা বলেনি, আমাদের চাষিদের সঙ্গে কোনও কথা বলেনি, কৃষি মন্ত্রণালয়কে জানায়নি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানায়নি। নিজেরাই হঠাৎ করে লোহার মই চাপিয়ে দেওয়ার মতো আমাদের ওপর এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছেন।’
একই দাবিতে এর আগে গত ২৮ ডিসেম্বর তানোর উপজেলার কৃষকরা এলাকায় বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। ভাড়া বৃদ্ধির ফলে তানোরের কয়েকটি হিমাগারের সামনেও বিক্ষোভ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৫ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে রাজশাহী কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান সেদিন বলেন, ‘গত বছর বস্তা হিসেবে হিমাগারে আলু নেওয়া হয়েছে। ৫০ কেজির বস্তায় ৩৪০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়েছে। এর ফলে কেজিপ্রতি সংরক্ষণে খরচ পড়ে প্রায় সাত টাকা। কিন্তু আলুর মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা বস্তায় ৭০ থেকে ৮০ কেজি পর্যন্ত আলু ঢুকিয়ে দেন। ফলে হিমাগারমালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। এর পরিপ্রেক্ষিতে এবার আলুর কেজি দরে ভাড়া নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
ফজলুর রহমান জানান, ব্যাংকের সুদহারসহ সব খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন চলতি মৌসুমে কেজিপ্রতি ভাড়া নির্ধারণ করেছে সর্বোচ্চ আট টাকা। এরপরও কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সিদ্ধান্ত রয়েছে, এই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা এর চেয়েও কম ভাড়ায় তারা নিজস্ব সিদ্ধান্তে আলু সংরক্ষণ করতে পারবেন।
রাজশাহী জেলা আলুচাষি ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নুরুল ইসলাম বলেন, ‘হিমাগারে আলু সংরক্ষণের ভাড়া ছিল প্রতি কেজি চার টাকা। এজন্য প্রতি বছর কৃষক বা ব্যবসায়ীরা হিমাগারে অগ্রিম বুকিং দিয়ে থাকেন। তবে এবার আলুর আবাদ শুরু হলে আলুচাষি ও ব্যবসায়ীরা বুকিং দিতে গেলে জানানো হয় প্রতি কেজি আলুর সংরক্ষণ ভাড়া আট টাকা করা হয়েছে। এ নিয়ে চাষিদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।’
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে ৩৭ হাজার ৬৬৭ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। এই পরিমাণ জমি থেকে ১০ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। রাজশাহী জেলায় কোল্ডস্টোরেজ রয়েছে মোট ৩৬টি। এর অধিকাংশই পবা, তানোর, মোহনপুর, বাগমারা ও দুর্গাপুর উপজেলায় অবস্থিত। এগুলোতে আলুর ধারণক্ষমতা ৯৫ লাখ বস্তা। ওজনের পরিমাপে যা পাঁচ লাখ টন।