আর্তমানবতার সেবায় কাজ করার কথা থাকলেও বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি যেন লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। মানুষের সেবার চেয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন নিজেদের আখের গোছাতেই বেশি ব্যস্ত। রেড ক্রিসেন্টের আওতাধীন কয়েকটি হাসপাতালে প্রকাশ্যে চলছে নিয়োগ বাণিজ্য। বছরের পর বছর নির্বাচন না হওয়ায় জেলা ইউনিটগুলোতে চলছে এক ব্যক্তির আধিপত্য। লোকবল সংকটের অজুহাতে এ বিষয়ে শক্ত মনিটরিং নেই ইউনিট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের।
রাজধানীর ঢাকায় বড় মগবাজারে হাতিরঝিল ঘেঁষে প্রায় ২০ বিঘা জমির ওপর বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সদর দপ্তর। কাগজে-কলমে এখানে তিন শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকলেও কাজের ক্ষেত্রে কোনো সমন্বয় নেই। পরিচালক পদে একজনকেই দেওয়া হয়েছে একাধিক বিভাগের দায়িত্ব। সারা দেশে সংস্থাটির নিয়ন্ত্রণাধীন একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, একটি ডেন্টাল কলেজ, দুটি চক্ষু হাসপাতাল, ৯টি রক্তদান কেন্দ্র, ছয়টি মাতৃসদন হাসপাতাল, ৫৬টি মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র (এমসিএইচ), একটি আউটডোর ক্লিনিক, তিনটি ডিপ্লোমা নাসিং ইনস্টিটিউট, দুটি নার্সিং কলেজ এবং চারটি মিডওয়াইফারি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট রয়েছে। তবে এর কোনোটিই ভালোভাবে চলছে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
Pause
Unmute
Remaining Time -10:23
Close Player
সম্প্রতি দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার মান কমে গেছে। হাসপাতালটির দীর্ঘদিনের সুনাম নষ্ট হওয়ায় রোগীর সংখ্যা ও আয় কমে গেছে। সার্বিকভাবে হাসপাতালটি ক্রমেই একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। রেড ক্রিসেন্ট চেয়ারম্যানের একচ্ছত্র ক্ষমতা ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে ওই গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের পরিচালক ও রেড ক্রিসেন্ট সদর দপ্তরের স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক প্রফেসর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. এস এম হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘টিআইবির গবেষণাধর্মী প্রতিবেদনের শতকরা ২৫ ভাগ সত্য হতে পারে। বাকি ৭৫ ভাগই মিথ্যা। ওই প্রতিবেদন তৈরি ও প্রকাশের আগে তারা আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি।’
হাসপাতালে চেয়ারম্যানের আধিপত্যের তথ্যকে মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাবি করে পরিচালক বলেন, ২০২২ সালের নভেম্বরে এখানে যোগদানের পর চেয়ারম্যান সবসময় তাকে সহায়তা করেছেন। কোনো কাজে কখনো বাধা দেননি।
তবে লোকবল সংকটের কারণে দেশের কোথাও কোথাও রেড ক্রিসেন্টের কার্যক্রমে কিছু অনিয়ম হচ্ছে বলে তিনি স্বীকার করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, নিয়োগ কমিটি ও কার্যনির্বাহী কমিটির অনুমোদন ছাড়াই গত ১০ বছরে চট্টগ্রামের জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতালে অন্তত ৫৩ জন ডাক্তার, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন হাসপাতাল পরিচালনাকারী ডা. শেখ শফিউল আজমের মেয়ে, ভাতিজা, গৃহকর্মীসহ আট স্বজন। সাম্প্রতিক তদন্তে নিয়োগ প্রাপ্ত ২৩ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ব্যক্তিগত ফাইলে জাল সনদ, বয়স কমিয়ে দেখানোসহ নানা অসামঞ্জস্য ধরা পড়ে। শুধু তাই নয়, বছরের পর বছর কাজ না করে বেতন তোলার ঘটনাও প্রকাশ্যে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষায় এসব চিত্র উঠে এসেছে।
রেড ক্রিসেন্ট পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলা ইউনিটেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। গত ৪ ডিসেম্বর রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি রাজবাড়ী জেলা ইউনিটের নির্বাচনে অনিয়ম ও ভোট কারচুপির অভিযোগে সংবাদ সম্মেলন করেছেন ফকীর জব্বার-শামীমা ও মুনমুন পরিষদ। রাজবাড়ী প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় তারা ভোট পুনঃগণনার দাবি জানান।
লক্ষ্মীপুর রেড ক্রিসেন্টের যুব সদস্যদের পারিশ্রমিক ভাতার ১ লাখ ৯৪ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন ইউনিট অফিসার নাসরিন আক্তার। এ ঘটনায় গত ৩০ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করেন রেড ক্রিসেন্টের যুব প্রধান নিজাম উদ্দিন মোহন। এ ছাড়া সদস্যদের জন্য বরাদ্দকৃত গেঞ্জি আত্মসাতের অভিযোগও করেন যুব সদস্যরা। সোসাইটির জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন ফারুক অভিযোগটি মিথ্যা দাবি করলেও চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহজাহান বিষয়টি কার্যকরী কমিটিতে আলোচনা করে সদর দপ্তরেও জানিয়েছেন।
রেড ক্রিসেন্ট বরগুনা জেলা ইউনিট সূত্রে জানা যায়, সাধারণত রেড ক্রিসেন্টের তহবিল বৃদ্ধির লক্ষ্যে সাধারণ সদস্য (বার্ষিক) ও আজীবন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সদস্য হওয়ার জন্য ফরম সংগ্রহ করার পরও অনেকেই সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোতালেব মিয়ার লোক না হওয়ায় সাধারণ সদস্য ও আজীবন সদস্য হতে পারেননি। এ বিষয়ে স্বজনপ্রীতি এবং স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। গোপালগঞ্জেও সদস্য পদ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়ম ও জটিলতা চলছে বলে জানা গেছে।
কিশোরগঞ্জে ১০ বছর ধরে চিঠি পান না রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির আজীবন সদস্যরা। ২০২০ সালের কার্যকরী কমিটি নির্বাচন নিয়েও সেক্রেটারি লুৎফর রহমান চৌধুরী হেলালের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ করে তাকে অবাঞ্ছিত করেছেন সদস্যরা। ২০২২ সালের কমিটিকেও অবৈধ কমিটি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন আজীবন সদস্যরা। রেড ক্রিসেন্ট দিবসেও এ ইউনিটের কার্যালয়ে তালাবদ্ধ থাকে বলে জানা গেছে।
দীর্ঘদিন ধরে রাঙামাটি জেলা ইউনিটের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি লুটপাট ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ করেছেন একাংশের নেতারা। এ ছাড়া এডহক কমিটিতে দলীয় লোকদের পুনর্বাসন করার অভিযোগও উঠে আগের কমিটির বিরুদ্ধে। এসব কর্মকাণ্ডে রেড ক্রিসেন্টের কেন্দ্রীয় সদর দপ্তরের মহাসচিবকেও জড়ানো হয়। এডহক কমিটিকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে করা রিট আবেদনে অবৈধ কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করে দেন আদালত।
নরসিংদীতে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গত ১৪ বছর ধরে সাধারণ সম্পাদকের পদ দখল করে আছেন বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি রিসালদার মুসলেহ উদ্দিনের আশ্রয়দাতা সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সাত্তার। মো. মনির হোসেন ভূঞা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর পদাধিকার বলে সংস্থাটির চেয়ারম্যান হন। এরপর তিনি ইউনিটের অতীতের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগের পর ছয় মাস অতিক্রান্ত হলেও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ক্ষোভ প্রকাশ করে এই চেয়ারম্যান বলেন, এরপর থেকে তিনি এই প্রতিষ্ঠানে আসা-যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।
এ বিষয়ে রেড ক্রিসেন্ট সদর দপ্তরের ইউনিট অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক নাজমা পারভীন কালবেলাকে জানান, বিষয়টি তদন্তের জন্য উপপরিচালক কবীর ফকির ও নূর শিকদারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কবীর ফকির তাকে জানিয়েছেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জিএম তালেবের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছেন, সেখানকার রেড ক্রিসেন্টের সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সাত্তার বঙ্গবন্ধুর খুনির আশ্রয়দাতা নয়। তবে তিনি প্রবাসে থাকার সময় তার বাড়িতে খুনি রিসালদার মুসলেহ উদ্দিন ভাড়া ছিল।’
এ বিষয়ে নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জি এম তালেবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালবেলাকে জানান, এ বিষয়ে রেড ক্রিসেন্টের কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে তার কোনো কথা হয়নি।
দেশের বিভিন্ন ইউনিটে ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরে একই ব্যক্তি ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন ইউনিট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের উপপরিচালক কবীর ফকীর। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে লোকবল কম, তাই মনিটরিং করা যাচ্ছে না।’
বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি রিসালদার মুসলেহ উদ্দিনের আশ্রয়দাতা ১৪ বছর ধরে নরসিংদী ইউনিটের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তার বাড়িতে একসময় রিসালদার মুসলেহ উদ্দিন ভাড়া থাকত একথা তারা জানতে পেরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন।
সৌজন্যে, কালবেলা