দেশের রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের প্রধান উৎসগুলোতে শক্ত ঘাঁটি গেড়েছে হুন্ডিচক্র। দেশীয় অর্থ পাচারকারীদের ছত্রছায়ায় মধ্যপ্রাচ্যের পর যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপেও বিস্তৃত হয়েছে হুন্ডির জাল। তবে বর্তমানে এর প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। সেখানে শত শত প্রতিষ্ঠান গড়ে তার আড়ালে হুন্ডি শুরু করে দেশীয় পাচারকারীরা। পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমে এ নিয়ে খবর প্রকাশ হলে চক্রটির নতুন গন্তব্য হয় ইউরোপের দেশ পর্তুগাল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে গত অর্থবছর থেকেই অস্বাভাবিক হারে কমছে রেমিট্যান্স। এবার সেই তালিকায় নাম লিখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। চলতি অর্থবছরে এসব দেশ থেকে রেমিট্যান্সের ধারা নিম্নমুখী। কয়েকটি দেশ থেকে আসা রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের নানামুখী উদ্যোগের পরও এক্ষেত্রে সুফল মিলছে না। দেশ থেকে অর্থ পাচারের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় রমরমা ব্যবসায় মেতেছে হুন্ডিচক্র। প্রবাসী বাংলাদেশিদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসার আগেই পাচার হয়ে যাচ্ছে অন্য দেশে। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসী শ্রমিকদের বেশিরভাগই অবস্থান করেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। বার্ষিক রেমিট্যান্সের অর্ধেকই আসে সেখান থেকে। রেমিট্যান্স সংগ্রহে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, লিবিয়া ও ইরান উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ২০২২ সাল থেকে এসব দেশ থেকে আসা প্রবাসী আয় আশঙ্কাজনক হারে কমতে শুরু করে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘অবৈধ হুন্ডি বন্ধ না হলে রেমিট্যান্স বাড়ানো সম্ভব নয়। তবে এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠান সৌদি আরবের প্রবাসীরা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ওই দেশ থেকে এসেছে ৪৫৪ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স। কিন্তু এক বছর আগেও এর পরিমাণ ছিল অনেক বেশি।
তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৭২ কোটি ডলার পাঠিয়েছিলেন তারাই। এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ৩৭৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ দুই বছরের ব্যবধানে ১৯৬ কোটি ডলারের পার্থক্য তৈরি হয়েছে। দেশটির রেমিট্যান্স এখনও হুন্ডির কবল থেকে মুক্ত হতে পারেনি। চলতি অর্থবছরের সাত মাসে (জুলাই থেকে জানুয়ারি) সৌদি আরব থেকে আসে ১৬০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অর্থবছর শেষে দেশটি থেকে আড়াইশ কোটি ডলারের কিছুটা বেশি রেমিট্যান্স আসতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতেও রেমিট্যান্সের প্রবাহ নিম্নমুখী। ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে সবকটি দেশ থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে। চলতি অর্থবছরেও নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত রয়েছে। তবে ব্যতিক্রম শুধু মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। আলোচ্য সময়ে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। হুন্ডিচক্রের ঘাঁটি রয়েছে দেশটিতে। তবে নিজেদের প্রয়োজনেই অনেক সময় কিছু অর্থ বৈধ পথে আনতে হয়, তাই দেশটি থেকে রেমিট্যান্স বাড়ছে বলে ধারণা কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের।
দেশটি থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরের রেমিট্যান্স এসেছিল ২০৭ কোটি ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ অঙ্ক প্রায় ১০০ কোটি ডলার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০৩ কোটি ডলারে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আরব আমিরাত প্রবাসী আয় আসার শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে।
তথ্য বলছে, মধ্যপ্রাচ্যের পর হুন্ডিচক্রের তৎপরতা বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। কারণ দেশটি বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর শীর্ষ তালিকায় অবস্থান করছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ৩৫২ কোটি ডলার। অর্থাৎ মাসে গড় রেমিট্যান্সের প্রবাহ ছিল ২৯ কোটি ডলার। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশটি থেকে রেমিট্যান্সে ধস নেমেছে। প্রতিমাসে গড় রেমিট্যান্স কমেছে ১০ কোটি ডলার। অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে এসেছে ১৩৩ কোটি ডলার।
খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, মালয়েশিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুরসহ বেশ কয়েকটি দেশে পাচারকারীরা বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতারাও রেমিট্যান্স পাচারের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। তাদের অনেকে এক দেশ থেকে রেমিট্যান্সের টাকা সংগ্রহের পর বিনিয়োগ করছেন আরেক দেশের বিভিন্ন খাতে। অনেক ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তি বর্তমানে বিদেশে পরিবারসহ বাস করছেন। তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহসহ ক্ষেত্রবিশেষে বিদেশে তাদের সম্পদ বা ব্যবসা-বাণিজ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন বা চাহিদা তৈরি হয়েছে। তারা এই চাহিদা পূরণ করছেন হুন্ডিচক্রের মাধ্যমে এবং প্রবাসী আয় সংগ্রহ করে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করে যাচ্ছে। প্রণোদনাসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোও বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে সব ধরনের অনিয়ম ও কারসাজি বন্ধে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ করছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্থবছরের সাত মাসে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২৪২ কোটি ৫২ লাখ ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সৌদি আরব আর তৃতীয় অবস্থানে ব্রিটেন। এ ছাড়া রেমিট্যান্স পাঠানোয় শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ওমান, মালয়েশিয়া, কুয়েত, ইতালি, কাতার ও বাহরাইন।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘অনেক বেশি শ্রমিক বিদেশে গেলেও সেই অনুপাতে রেমিট্যান্স আসছে না বা আসতে দেওয়া হচ্ছে না। কারণ অর্থ পাচারকারীরা তা কিনছে এবং সমপরিমাণ অর্থ সুবিধাভোগীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। নির্বাচনের কারণে ২০২৩ সালে এই প্রবণতা বেশি দেখা গেছে। ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স খুব বেশি বাড়েনি।’
চলতি অর্থবছরে জানুয়ারি পর্যন্ত সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ১৬০ কোটি ১০ লাখ ডলার। এ ছাড়া ব্রিটেন থেকে ১৬১ কোটি ডলার, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৩৩ কোটি ২৮ লাখ, ইতালি থেকে ৮৯ কোটি ৯৯ লাখ, মালয়েশিয়া থেকে ৮৪ কোটি, কুয়েত থেকে ৭২ কোটি ৮৭ লাখ, কাতার থেকে ৬৩ কোটি ৬৫ লাখ, ওমান থেকে ৫৩ কোটি ৪৯ লাখ এবং বাহরাইন থেকে এসেছে ৩১ কোটি ১৭ লাখ ডলার। তবে জনশক্তি রপ্তানি রেকর্ড পরিমাণ বাড়লেও সেই অনুপাতে বাড়ছে না রেমিট্যান্স।
জনশক্তি রপ্তানি ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে আগের বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি জনশক্তি রপ্তানি করে রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ। সৌদিতে বাংলাদেশি কর্মী (জনশক্তি) নিয়োগে কোটা বাড়ানো এবং মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার আবার খুলে দেওয়ার ফলে জনশক্তি রপ্তানির এই রেকর্ড সম্ভব হয়েছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, গত বছর বিশ্বের ১৩৭টি দেশে বাংলাদেশের ১৩ লাখ কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার। তবে জনশক্তি রপ্তানিতে মাইলফলক অর্জন সত্ত্বেও সে অনুযায়ী বাড়েনি রেমিট্যান্স প্রবাহ। ২০২৩ সালে রেমিট্যান্স প্রবাহ ৩ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ১৯২ কোটি (২১ দশমিক ৯২ বিলিয়ন) ডলার। আগের বছর যা ছিল ২ হাজার ১২৯ কোটি (২১ দশমিক ২৯ বিলিয়ন) ডলার। সে হিসেবে গত দুই বছর ধরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ২২ বিলিয়ন ডলারের নিচে স্থবির হয়ে আছে।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি অর্থ পাচারের নতুন নতুন গন্তব্য খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইউরোপের দেশ পর্তুগালে অর্থ পাচারের ঘাঁটি গেড়েছে বাংলাদেশের আড়াই হাজার নাগরিকের একটি বিশাল চক্র। নিরাপদে অর্থ সরিয়ে নিতে তারা দেশটির নাগরিকত্বও নিয়েছে। ইতোমধ্যে দেশটিতে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইয়ের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। বর্তমানে অর্থ পাচারের প্রধান রুট হিসেবে দেশটি ব্যবহৃত হচ্ছে। পাচারকার্য পরিচালনার জন্য দুবাইয়ে ১৩ হাজার প্রতিষ্ঠান খুলেছে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। সেখানে বিনিয়োগ করা হয়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। রাজনীতিবিদ ও আমলাদের অর্থ পাচারের বাহক হিসেবে কাজ করছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো। প্রভাবশালীদের প্রশ্রয়ে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে এবং হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল অর্থ পাচার করে বিদেশে বিশাল সাম্রাজ্য গড়েছে কয়েকটি শিল্পগ্রুপ। তাদের হাতেনাতে ধরার পরও শাস্তি দেওয়া দূরে থাক, নামটি পর্যন্ত মুখে আনতে পারছেন না খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। কারণ তারা সবাই ক্ষমতার কেন্দ্রে ঘাঁটি গেড়েছেন।
পাঠকের মতামত