আমীন আল রশীদ::
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিয়ে ২০০৭ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে ‘দেশহীন জাতির গল্প’ শিরোনামে সিরিজ রিপোর্ট করার সুবাদে বেশ কয়েকদিন আমাকে থাকতে হয়েছিল টেকনাফের কুতুপালং ক্যাম্পসহ রোহিঙ্গারা বসবাস করেন এমন সব জায়গায়। মূল উদ্দেশ্য ছিল, খুব কাছ থেকে তাদের সংকট দেখা। সম্প্রতি জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত আনান কমিশনও রোহিঙ্গাদের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘দেশহীন জাতি’ বলে উল্লেখ করেছে।
বুধবার (২৩ আগস্ট) মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে আনান কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়ার পরদিনই সেখানে নতুন করে যে সহিংসতা ছড়িয়েছে, তাতে এ পর্যন্ত (শুক্রবার রাত) অন্তত ৭১ জনের নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বার্তা সংস্থা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই সুযোগে রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূলে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে পারে মিয়ানমার সরকার; যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে বাংলাদেশের সীমান্তে ফের নেমেছে রোহিঙ্গাদের ঢল। তাদের ঠেকাতে তৎপর বিজিবি।
আনান কমিশনের ওই প্রতিবেদনে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর আরোপিত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ প্রত্যাহার, তাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানানোর পরদিনই যেভাব রাখাইনে সহিংসতা ছড়িয়েছে, সেটির সূত্রপাত এখনো পরিষ্কার নয়। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ যথারীতি রোহিঙ্গা মুসলমানদের সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (এআরএসও)-এর প্রতি ইঙ্গিত করেছে।
এখানে একটি বিষয় আমাদের খুব পরিষ্কার বোঝা দরকার যে, যখন কোনো জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হতে থাকে, তখন তাদের এই ক্ষোভ সংঘবদ্ধ রূপ নিয়ে যে বিস্ফোরণ ঘটে, সেটি অনেক সময় জঙ্গিবাদেও রূপ নিতে পারে। ইরাকে কী পরিস্থিতিতে এবং কী কারণে আইএসের মতো সংগঠনের আত্মপ্রকাশ অথবা বিকাশ–– তা এখন সবার জানা। সুন্নি জনগোষ্ঠীর প্রতি শিয়া সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণে সাধারণ মানুষের মনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ কাজে লাগিয়েই মূলত আইএস তাদের শক্তি বাড়িয়েছে। ফলে ইরাকের সেনাবাহিনী যখন আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেছে, তখন অনেক সাধারণ মানুষ আইএসকে সহায়তা করেছে।
আনান কমিশনের রিপোর্টেও এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে যে, যদি স্থানীয় জনগণের বৈধ অভিযোগগুলো উপেক্ষা করা হয়, তাহলে তারা জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিতে পারে অথবা জঙ্গি সংগঠনগুলো সাধারণ মানুষের এই ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে নিজেদের অন্য কোনো স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করবে।
এখন প্রশ্ন হলো, রোহিঙ্গারা কোথায় যাবেন? গত বছরের অক্টোবরে রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার পর প্রায় পৌনে এক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর সরকারের তরফে বলা হয়েছিল, নোয়াখালীর ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করা হবে। যদিও ওই চরটি এখনো মানুষের বসবাসের উপযোগী নয় বলে সেখানে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের নামে পাঠানো হলে আরেক ধরনের সংকট তৈরি হবে বলেও আশঙ্কা রয়েছে।
অর্থাৎ ঠেঙ্গারচর কোনো সমাধান নয়। কারণ, মিয়ানমারের রাষ্ট্রযন্ত্র যদি রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার না করে এবং রাখাইন রাজ্যে হত্যাকাণ্ড বন্ধ না করে, তাহলে এ সমস্যার সমাধান হবে না। বাংলাদেশ যদি ক্রমাগত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে থাকে, তাহলে এটি মিয়ানমারকে নির্যাতনে আরো উৎসাহিত করবে। সুতরাং এর সমাধান প্রথমত মিয়ানমার সরকারের রাজনৈতিক শুভবুদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক মহলের ওপর, যারা শুরু থেকেই মিয়ানমারকে এ বিষয়ে চাপে রাখলে বাংলাদেশে এভাবে দলে দলে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসত না বলে অনেকেই মনে করেন।
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং সর্বোপরি প্রতিবেশী ভারত-চীন ও যুক্তরাষ্ট্র যদি একযোগে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে, এমনকি অবরোধ আরোপের হুমকি দেয়, তাহলেই কেবল রাখাইন রাজ্যে জাতিগত নিধন বন্ধ হতে পারে। যদিও মিয়ানমার সরকার যে আন্তর্জাতিক চাপের কোনো ধার ধারে না––তার প্রমাণ সবশেষ এই সহিংসতা। কেননা আনান কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়ার পরদিনই সেখানে সহিংসতা ছড়িয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গাদের চীনে আশ্রয় দেওয়া গেলে তারা একটি ইতিবাচক-সুশৃঙ্খল জীবনের স্বাদ পাবে। কিন্তু চীন এই দায়িত্ব নেবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুটি একটি জাতিগত সংখ্যালঘু ও আন্তর্জাতিক সমস্যা। সুতরাং এই সমস্যার দায় যেমন বাংলাদেশের নয়, তেমনি এই সমস্যা সমাধানের দায়িত্বও বাংলাদেশের নয়। বাংলাদেশ মানবিক কারণে সেখান থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। এই সমস্যার সমাধান মিয়ানমারের হাতেই। মিয়ানমারের রাষ্ট্রযন্ত্র যদি রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার না করে এবং রাখাইন রাজ্যে হত্যাকাণ্ড বন্ধ না করে, তাহলে এই সমস্যার সমাধান হবে না।
তবে রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে আমরা যতটা রাজনৈতিকভাবে দেখে অভ্যস্ত, মানবাধিকারের দৃষ্টিতে যেন ততটা দেখতে চাই না। কেননা, কক্সবাজার ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে এখন রোহিঙ্গা শুনলেই আমাদের চোখের সামনে যেন কিছু অপরাধী মুখ ভেসে ওঠে। অথচ কী পরিস্থিতিতে একটি বিশাল জাতিগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, একটি প্রজন্ম কীভাবে দেশহীন পরিচয়ে বেড়ে উঠছে, কীভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে এবং এই বঞ্চনার ফলে তাদের ভেতরে কী ধরনের ক্ষোভ জন্ম নিচ্ছে–সেটি আমরা বুঝেও ঠিক বুঝতে চাই না। কেননা, সংকটটা আমাদের নয়। আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশিদের নয়, এটা হয়তো ঠিক; কিন্তু সংকটটা মানুষের তো!
আমীন আল রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক।
পাঠকের মতামত