হোসাইন মুবারক::
‘একজন রোগীর পিঠব্যথা। ডাক্তারের কাছে গেলেন। বহু পরীক্ষার পর ডাক্তার রোগীকে ছয়টি ওষুধ দিলেন। উপশম না হওয়ায় দ্বিতীয় ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন রোগী। দ্বিতীয় ডাক্তার আগেরগুলোসহ আরো ১১টি ওষুধ লিখে দিলেন। মোট ১৭টি ওষুধ দুই মাস ব্যবহার করলেন রোগী। এর পরও কোনো উন্নতি না হওয়ায় অবসাদগ্রস্ত হয়ে ওই রোগী বিদেশী ডাক্তারের কাছে গেলেন। এবার বিদেশী ডাক্তার ওই ১৭টি বাদ দিয়ে একটি ওষুধ দিলেন।’ গল্পের মতো এ ঘটনাটি উঠে এসেছে একটি জাতীয় দৈনিকে। প্রকাশিত সংবাদের এই ঘটনা সমাজের আরো পাঁচজন রোগীর মতো বিচ্ছিন্ন কোনো অনুগল্প নয়। এমন অহরহ ঘটনা রয়েছে আমাদের চার পাশে। ওষুধের অতিরিক্ত প্রয়োগ নানা কারণেই হচ্ছে।
চিকিৎসাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকী ‘দ্য ল্যানচেট’-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ^জুড়ে রোগীদের অপ্রয়োজনীয় এবং দামি ওষুধ দেয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। অনেক সময় কম খরচে রোগ নিরাময়ের উপায় থাকলেও রোগীদের ওপর বাড়তি খরচ চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। দুই ডাক্তার যেমন দামি ওষুধ লিখেছেন তেমন বেশি ওষুধও লিখেছেন। বলা যায়, সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করতে না পারার কারণে ওষুধের প্রয়োগ করা হয়েছে বেশি। খবরের ভেতরের অংশে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ যেটা অপব্যবহার হয়, সেটা হচ্ছে ভিটামিন এবং অ্যান্টিবায়োটিক। চিকিৎসকেরা একটি অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে যখন নিশ্চিত হতে পারেন না যে, এতে রোগ নিরাময় হবে; ঠিক তখন একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দেন। এটিও একটি বেশি ওষুধ লেখার প্রবণতা। এখানে ডাক্তারদের জানার পরিধি ও বোঝার গভীরতার বিষয়টি চলে আসে। যেসব ডাক্তার বেশি মেধাবী তাদের চিকিৎসা প্রদানের যোগ্যতাও তত বেশি। মাত্রাতিরিক্ত ওষুধের ব্যবহার সব ডাক্তারই যে করেন, তা কিন্তু বলা যাবে না; তবে আমাদের দেশে যে চিত্রটি আলোচনার জন্ম দিয়েছে, তা এ থেকে মোটেই ব্যতিক্রম নয়।
ওষুধ যদি মাত্রাতিরিক্ত হয় তাহলে রোগী বেঁচে ওঠার চেয়ে আরো অসুস্থতার দিকে ধাবিত হবে। দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধের মানের প্রশ্নে এগিয়েছে অনেক দূর। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশে^র অনেক উন্নত দেশে আমাদের ওষুধ রফতানি হচ্ছে। ওষুধের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান উন্নত দেশের নাগরিকেরা ব্যবহারের আগে এর মান নিয়ে অনেক যাচাই-বাছাই করেÑ এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেসব দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানিকৃত ওষুধের মান পরীক্ষার পর নাগরিকদের ব্যবহারের অনুমতি দেয়। আমাদের দেশের রফতানিযোগ্য ওষুধগুলো এভাবেই পরীক্ষার স্তর অতিক্রম করে এগিয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।
‘ভেজাল ওষুধে বাজার সয়লাব’Ñ এ খবরও রয়েছে। এটি এদেশীয় ওষুধ শিল্পের বিপরীত চিত্র। আমাদের যেমন আছে বাজারে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন রফতানিমুখী ওষুধ, তেমনই আছে গ্রামপর্যায়ে নি¤œমানের ওষুধের বাজার এবং সেই সাথে আছে যথেচ্ছ ব্যবহার। দেশের মেডিক্যাল ও ক্লিনিকগুলোতে দেখা যায় বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের ভিড়। তারা ডাক্তারদের কর্মসময়ের মধ্যে নিজ কোম্পানির ওষুধের প্রচার চালান। উপহার হিসেবে দেন রাইটিং প্যাড, স্যাম্পল ওষুধ, সুদৃশ্য কলম, চিত্তাকর্ষক পেপারওয়েটসহ বিভিন্ন সামগ্রী। ডাক্তারদের উপঢৌকন দেন নিজস্ব কোম্পানির ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লেখার জন্য। এই চিরচেনা দৃশ্য নিত্যদিনের। অনেক সচেতন রোগীর কাছে এ দৃশ্য খুবই বিরক্তিকর। তারপরও এটা কোনো কোনো ডাক্তারের কাছে একটা সংস্কৃতির মতো হয়ে গেছে। চিকিৎসাঙ্গনে এর বিপরীত চিত্রও আছে। অনেক ডাক্তার আছেন, তারা আবার এর সরাসরি বিরোধী। তারা কোনো ওষুধ প্রতিনিধিকে চেম্বারে ঢুকতে দেন না। কোথাও আবার লেখা আছে, ‘ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের প্রবেশ নিষেধ’।
যেসব ডাক্তার ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের কদর করেন, তাদের বিরুদ্ধে আবার অতিরিক্ত ওষুধ লিখে ওই কোম্পানির ওষুধ বিক্রিতে প্রবাহ সৃষ্টি করার অভিযোগও কম নয়। গুরুতর অনৈতিক লেনদেনের বিস্তর অভিযোগও শোনা যায়। এ কারণে অনেক দেশে ওষুধের জেনোরিক নাম লেখার নিয়ম আছে, সরাসরি কোম্পানির দেয়া নাম নয়। পাশের দেশ ভারতেও জেনোরিক নাম লেখার বিধান রয়েছে। এ নিয়ে ক’দিন আগে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়েছে। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত স্পষ্ট অক্ষরে পড়ার উপযোগী করে ব্যবস্থাপত্র ও ওষুধের নাম লেখার নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই সাথে ওষুধের জেনোরিক নাম লেখার নির্দেশনা দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সার্কুলার জারি করতে বলা হয়েছে, যা বর্তমানে খুবই জরুরি ছিল।
যারা গুটিকয়েক ওষুধের আইটেম তৈরি করে ওষুধ কোম্পানির যাত্রা শুরু করেন তাদেরও একটাই লক্ষ্য থাকে বড় কোম্পানি হওয়ার। এগুলোর কোনো কোনোটি ছোট থেকে বৃহত্তর কোম্পানির রূপ নেয়। আবার কেউ বা চলে যায় তৃণমূলে। নিজেদের স্বল্পমানসম্পন্ন ওষুধ বাজারে চালানোর চেষ্টা করে বিভিন্ন অনৈতিক পন্থায়।
অনেক ডাক্তার রোগীর জন্য যে ওষুধ লিখেন তা অনেক সময় ফার্মেসির কর্মীরা পড়তে পারেন না। এর ফলে ভুল ওষুধ চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনেকে ভুল ওষুধ ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্তও হন। এ ছাড়া কোন ওষুধের মাত্রা কত? দিনে কোনটা কয়বার খেতে হবে, সেটাও অস্পষ্ট থাকে। এসব অস্পষ্টতার কারণে রোগীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয় বেশি।
আমাদের দেশে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও কোনো কোনো বড় মাপের ডাক্তার সহকারী রাখেন ব্যবস্থাপত্র স্পষ্ট করে লেখার জন্য। আবার অনেক সরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে কম্পিউটারের মাধ্যমে কম্পোজ করে ব্যবস্থাপত্র দেয়া হয়। এ বিষয়ে সরকারি নির্দেশনা থাকলে রোগীরা আরেকটি ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেত।
ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্রভাবে অতিরিক্ত ওষুধ লেখা থেকে ডাক্তারদের বেরিয়ে আসতে হবে, ওষুধের জেনোরিক নাম লেখা বাধ্যতামূলক করতে হবে, সর্বোপরি স্পষ্ট হাতের লেখা ব্যবস্থাপত্র চালু করতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে এসব সমস্যা যথাযথভাবে তদারকি করতে হবে। তাহলেই এ থেকে সাধারণ রোগীরা মুক্তি পাবে।
লেখক : সাংবাদিক
[email protected]