উখিয়া নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬/০৯/২০২৩ ৯:৪১ এএম
বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী

সময় টিভি::
আসিয়ান সম্মেলন শুরু হতেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আবারও ছলচাতুরি করছে মিয়ানমার। আন্তর্জাতিক চাপকে পাশ কাটাতেই ডিসেম্বরের মধ্যে মাত্র ৩ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়ার মৌখিক সম্মতি দিয়েছে দেশটি। সচেতন মহল এমন কূটকৌশলকে নতুন টালবাহানা বলছেন। আর দায়সারাভাবে তালিকা করায় প্রত্যাবাসন নিয়ে সন্দিহান শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান।

নতুন ও পুরনো মিলে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। এর মধ্যে গেলো ৬ বছরে ক্যাম্পে নতুন জন্ম নিয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার শিশু।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি চুক্তি হয় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। এতে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর ও ২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ ঠিক হলেও তা ভেস্তে যায় মিয়ানমারের ছলচাতুরিতে।

এরপর দীর্ঘসময় থমকে যায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। আর চলতি বছর চীনের মধ্যস্থতায় নতুন করে আলোচনায় আসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। দুদফা কক্সবাজারের টেকনাফে আসে মিয়ানমার প্রতিনিধি দল। কিন্তু তাতেও শুরু হয়নি প্রত্যাবাসন।

এদিকে, গতকাল মঙ্গলবার (০৫ সেপ্টেম্বর) ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় শুরু হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের ৪৩তম শীর্ষ সম্মেলন। এ সম্মেলনে সবসময় গুরুত্ব পায় রোহিঙ্গা সংকট।

এরই মধ্যে সোমবার (০৪ সেপ্টেম্বর) নেইপিদোতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তারা বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে তিন হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে মৌখিক সম্মতি জানায় মিয়ানমার। সচেতন মহলের দাবি, আসিয়ান সম্মেলন ও আন্তর্জাতিক চাপকে পাশ কাটাতে প্রত্যাবাসন ইস্যুতে নতুন করে ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়েছে মিয়ানমার।

কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় আসিয়ান সম্মেলন শুরু হচ্ছে। এতে দেশটির ওপর চাপ আসতে পারে, তাই নেপিদোতে দুদেশের বৈঠকে মৌখিকভাবে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ৩ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাস দিয়েছে মিয়ানমার। রোহিঙ্গা আসার পর থেকে মিয়ানমার একাধিকবার আশ্বাস দিয়েছে এবং তাদের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে; কিন্তু ৬ বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেযো হয়নি। এটা মিয়ানমারের ছলচাতুরি কিনা, আসলে রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমার নেবে কিনা – এটা নিয়ে আমরা সন্দিহান।’

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাহমুদুল হক চৌধুরী জানালেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিতে আগ্রহী; কিন্তু বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের পাঠাতে অক্ষম – এটা আন্তর্জাতিক মহলকে দেখাতে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে মিয়ানমার।

তিনি বলেন, মৌখিক সম্মতি যদি হয়, তাহলে তা কখন, কোন তারিখে ফিরিয়ে নেয়া হবে, তা নির্ধারণ হলো না কেন? আর বাংলাদেশে তো এখন নির্বাচনের সময়। এ সময়টাতে কেন মিয়ানমার ৩ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিতে নিতে মৌখিক সম্মতি জানাল, এটাকে মিয়ানমারের কূটকৌশল, পাঁয়তারা বা ভেলকিবাজি মনে হচ্ছে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ সবসময় প্রস্তুত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মিয়ানমার কতটুকু আন্তরিক, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে বলে জানালেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, ২০১৮ সালে কয়েক দফায় ৮ লাখের বেশি পরিবার-ভিত্তিক রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারকে হস্তান্তর করা হয়েছে। গত ৬ বছরে মিয়ানমার ১ লাখ ১ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা ভেরিফাই করে দিয়েছে। এটা মিয়ানমারের দৃষ্টিকোণ থেকে ভেরিফিকেশন, কিন্তু আমাদের দৃষ্টিতে ১ লাখ ১ হাজারের মধ্যে মাত্র ২০ হাজারকে পেয়েছি।

তিনি আরও বলেন, যারা প্রশ্নাতীতভাবে ভেরিফাইড এবং যেতে পারবেন এরকম মাত্র ২০ হাজার। বাকি রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমার বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। তারা প্রকৃতভাবে নিবন্ধিত নয়, তারা জঙ্গি গ্রুপের সদস্য- এসব বলে মিয়ানমার ভিন্ন তালিকাভুক্ত করেছে। সুতরাং ৮ লাখের বেশি রোহিঙ্গার তালিকা আমরা দিয়েছিলাম, মিয়ানমারের তরফ থেকে গত ৬ বছরে খুবই ধীরগতিতে এবং খুবই দায়সারাভাবে তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। আমরা শঙ্কিত, মিয়ানমার কতটুকু আন্তরিক এই প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে তা নিয়ে। তারপরও আমাদের পক্ষ থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি, আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে মিয়ানমারের সঙ্গে। আমরা আশা করব, প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার রাজি হবে। আমাদের প্রত্যাবাসন ছাড়া বিকল্প কোনো চিন্তা নেই।

হুমকি হয়ে ‍উঠছে রোহিঙ্গারা

দিন দিন স্থানীয়দের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে রোহিঙ্গারা। শুধু স্থানীয় নয়, পুরো দেশের নিরাপত্তার জন্যই হুমকি হয়ে উঠছে তারা। সম্প্রতি কাঁটাতারের বেড়া কেটে নিজেদের মতো দুই শতাধিক গেট তৈরি করার অভিযোগ উঠেছে ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে। নিয়ন্ত্রণহীন এসব গেট দিয়ে ক্যাম্প ছেড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যাওয়ার চেষ্টার পাশাপাশি লোকালয়ে গিয়ে অপরাধে জড়াচ্ছেন রোহিঙ্গারা।

কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের পাশেই উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প। এ ক্যাম্পের চারপাশে রয়েছে কাঁটাতারের নিরাপত্তা বেষ্টনি। কিন্তু এ ক্যাম্পের এক কিলোমিটার এলাকায় ১০টি অংশে কাঁটাতারের বেড়া কেটে তৈরি করা হয়েছে গেট। আর এসব গেট দিয়ে নিজেদের মতো করে অবাধে যাতায়াত করছেন রোহিঙ্গারা।

কুতুপালংয়ের আমগাছতলা এলাকায় দেখা যায়, কাঁটাতারের বেড়ার সঙ্গে রয়েছে একটি গ্রিলের গেট। এ গেট পার হয়ে সহজে ক্যাম্প ছেড়ে বের হয়ে যাচ্ছেন রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুরা। একই গেটের পাশে রয়েছে একটি ছোট ফাঁক। ওই ফাঁক দিয়েও ক্যাম্প ছেড়ে বের হয়ে যাচ্ছেন শত শত রোহিঙ্গা।

শুধু এখানে নয়, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পেও একই অবস্থা। কাঁটাতারের বেষ্টনির ২০০ অংশে কেটে রোহিঙ্গারা নিজেদের ইচ্ছেমতো গেট তৈরি করে ক্যাম্প ছেড়ে যাতায়াত করছে লোকালয়ে। তারপর কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছেন রোহিঙ্গারা।

ক্যাম্পের প্রবেশদ্বারে রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া বন্ধে বসানো হয়েছে এপিবিএন পুলিশের চেকপোস্ট। কিন্তু অনেক সময় চেকপোস্টগুলোর শিথিলতার সুযোগে ফাঁকফোকর দিয়েও বের হচ্ছে রোহিঙ্গারা। একই সঙ্গে মেরিন ড্রাইভ কিংবা কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে তুলে নেয়া হয়েছে অনেক চেকপোস্ট। স্থানীয়দের দাবি, ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গারা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন,
গেল ৬ বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও প্রত্যাবাসন করা হয়নি। আর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোনো আশাও দেখছি না। এর কারণে রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে লোকালয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে যেভাবে বের হচ্ছে এটা খুবই আতঙ্ক ও উদ্বেগের বিষয়। এটা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকির বলে মনে করছি।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা মাহমুদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ার কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হচ্ছে। এভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। তাই সরকার, প্রশাসন, সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ছেড়ে বের হয়ে যাওয়া বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক ও মেরিন ড্রাইভে চেকপোস্টগুলো সচল করে নজরদারি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তা নাহলে রোহিঙ্গারা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

মিয়ানমারের জাতিগত নিধনযজ্ঞ ও গণহত্যা

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনী উত্তর রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তাদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করতে ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে। পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে সেনারা বেসামরিক রোহিঙ্গা নাগরিকদের হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন করে এবং ওই অঞ্চলে রোহিঙ্গা গ্রামগুলো পুড়িয়ে দেয়।

তথ্য-উপাত্ত বলছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানে ও স্থানীয় অধিবাসীদের হামলায় কয়েকদিনে অন্তত ১০ হাজার রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হয়। ৩ শতাধিক গ্রাম পুড়িয়ে তামা করে দেয়া হয়। নির্যাতন ও নিপীড়নের মুখে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। যারা আগে থেকে আশ্রয় নেয়া আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে যোগ দেয়। ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বোঝা বইতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

পাঠকের মতামত

উখিয়ার সোনার পাড়া হাটেই বিক্রি হচ্ছে ৮০ লাখ টাকার সুপারি, খুশি চাষিরা

আব্দুল কুদ্দুস,কক্সবাজার কক্সবাজারে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার বাম্পার ফলন হয়েছে সুপারির। ভালো দামও পাচ্ছেন চাষিরা। ...

রোহিঙ্গা ক্যাম্প মুখি নয়, কলেজ মুখি হতে হবে শিক্ষার্থীদের-শাহজাহান চৌধুরী

নিয়মিত ক্লাস পরীক্ষায় মেধা প্রস্ফুটিত হয়। উচ্চ শিক্ষায় অভিভাবক শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সমন্বয়ে আগামীর সুন্দর ...

চেয়ারম্যান ও ৩ প্যানেল চেয়ারম্যান অনুপস্থিত : হ্নীলা ইউনিয়নের সেবা কার্যক্রম বন্ধ

টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের সেবা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ইউনিয়নেরে চেয়ারম্যান ও প্যানেল চেয়ারম্যান ৩ জন অনুপস্থিত ...