জাতিগত নিপীড়নের মুখে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এসব রোহিঙ্গা এখন স্থানীয়দের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। উখিয়া-টেকনাফের পাশাপাশি পুরো জেলার শ্রমবাজারে এখন রোহিঙ্গাদের দাপট দৃশ্যমান।
স্থানীয়রা বলছেন, একদিকে রোহিঙ্গাদের অস্ত্রবাজি, অপহরণ, ডাকাতির ভয়ে আতঙ্কিত থাকেন তারা; অপরদিকে শ্রমবাজার দখল হয়ে যাওয়ায় দিনদিন এখানে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। উখিয়ার ব্যবসায়ী নুরু বশর জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে বলিবাজার, মুধুরছড়া বাজার, জামতলা বাজারসহ আরও কয়েকটি বাজারে ১০ হাজারের বেশি দোকানপাট রয়েছে। এর ৭০ শতাংশের মালিক রোহিঙ্গারা। সেখানে অন্তত ১২ থেকে ১৫ হাজার রোহিঙ্গার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। শুধু উখিয়া উপজেলায়ই অর্ধলাখের বেশি রোহিঙ্গা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছে।
উখিয়া, টেকনাফসহ বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা যায়, রিকশা, অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত টমটম, মাহিন্দ্র গাড়ির চালক, খাবার হোটেল, আবাসিক হোটেল, গ্রামীণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ, জেলেদের ফিশিং বোটে, বিভিন্ন প্রকার যানবাহন ও ব্যবসা-বাণিজ্য দখল করে নিয়েছে রোহিঙ্গারা।
এমনকি গুরুত্বপূর্ণ টেকনাফের স্থলবন্দরে শতভাগ রোহিঙ্গা শ্রমিক দিয়ে কাজ চলছে।
শুধু উখিয়া বা টেকনাফ নয়, কক্সবাজার শহরেও রোহিঙ্গাদের শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে দেখা গেছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিকের কাছে রোহিঙ্গা শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘স্থানীয়দের চেয়ে রোহিঙ্গারা স্বল্প বেতনে কাজ করে। তাই রোহিঙ্গা শ্রমিকদের কাজে নিচ্ছি।’
কথা হয় উখিয়া ১৩ ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গা টমটমচালক রহমত উলাহর সঙ্গে। কীভাবে ক্যাম্পের বাইরে বের হলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক রোহিঙ্গাই টমটম, রিকশা ও সিএনজি চালায়। এমনকি বন্দরেও কাজ করে। কাজ শেষে আবার ক্যাম্পে ফিরে যান। একই তথ্য দেন আরেক রোহিঙ্গা সিএনজিচালাক আবদু রহমান। তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা মালিকদের কাছ থেকে যানবাহন ভাড়া নিয়ে চালাই।
উখিয়া বলিবাজার ও মধুরছড়া বাজারের দোকানে কর্মরত রোহিঙ্গারা জানান, তারা কেউ ভাড়ায় কেউ আবার টাকার বিনিময়ে মালিকানা কিনে ব্যবসা করছেন। এতে তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, সেখানকার অন্তত ৪০ ভাগ পণ্যই মিয়ানমারের। বাকি পণ্যের (বিশেষ করে খাদ্যপণ্য) অর্ধেকই বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া ত্রাণসামগ্রী, যা নিজেদের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হওয়ায় বিক্রির জন্য দোকানে তুলেছে তারা।
উখিয়া পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারমান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, খেতখামার, ব্যবসাবাণিজ্য, গাড়ি চালনা থেকে শুরু করে সব ধরনের শ্রমবাজার রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে। ক্যাম্পের এনজিওগুলো স্থানীয়দের পরিবর্তে রোহিঙ্গা ও উত্তরবঙ্গের মানুষকে চাকরিতে নিচ্ছে। এতে স্থানীয়রা বেকার হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, আমরা এখন নাগরিক অধিকার নিয়ে শঙ্কিত। রোহিঙ্গাদের কারণে নিরাপত্তাহীনতা তো আছেই।
উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও রাজাপাং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, সব জায়গায় এখন রোহিঙ্গারাদের দাপট। শ্রমবাজার তাদের দখলে চলে গেছে। তিনি অভিযোগ করেন, এনজিও সংস্থা কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয়দের জন্য ২৫ শতাংশ বরাদ্দের কথা থাকলেও তা দেওয়া হচ্ছে না। এতে স্থানীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন আরও কঠিন হয়ে উঠেছে।
রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসান ও স্থানীদের অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে ‘আমরা কক্সবাজারবাসী’ নামের একটি সংগঠন। এর সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন বলেন, উখিয়া ও টেকনাফের প্রায় সবই রোহিঙ্গাদের দখলে। মিয়ানমারের এই জনগোষ্ঠীর দ্রুত প্রত্যাবাসন জরুরি। রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্পে থেকে বের হতে না পারে তাও নিশ্চিত করা দরকার। এভাবে যদি রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার সুযোগ পায়, তাহলে জেলার পুরো শ্রমবাজারই রোহিঙ্গদের দখলে চলে যাবে।
জানতে চাইলে ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মোহাম্মদ কামরান হোসেন বলেন, রোহিঙ্গাদের অনুমতি ছাড়া ক্যাম্প থেকে বর হওয়ার সুযোগ নেই। তবে কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁকফোকর দিয়ে অনেকে বের হয়ে যায়। আমরা সংশ্লিষ্টদের বিষয়টা জানিয়েছি। আশা করি এর সমাধান হয়ে যাবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের আটকানোর জন্য সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের পক্ষ থেকে একাধিক তলাশি চৌকি বসানো হয়েছে। সেখানে সন্দেভাজন ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও চেক করা হয়। এরপরও অনেকে কৌশলে হেটে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে।
শ্রমবাজার রোহিঙ্গাদের দখলে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশিদ বলেন, এ ধরনের খবর পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে টমটম, সিএনজিচালকসহ ক্যাম্প থেকে বের হয়ে বিভিন্ন কর্মে জড়িত রোহিঙ্গাদের আটক করে সংশ্লিষ্টদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। টেকনাফ বন্দরে রোহিঙ্গা শ্রমিক নিয়ে কাজ করার বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।
সামগ্রিক বিষয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার প্রভাব স্থানীয়দের ওপর পড়েছে। এই এলাকায় পরিবেশের ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে রোহিঙ্গারা বিভিন্ন জায়গায় শ্রমিকের কাজ করছে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি যেন তারা ক্যাম্পের বাইরে না আসতে পারে।