উখিয়া নিউজ ডেস্ক::
এশার নামাজের জন্য পুকুরে অজু করছিলেন আলী আহম্মদ। পুকুরটা বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে। হঠাৎ দেখতে পেলেন পুকুরের পানিতে দূর থেকে হলদে আলো এসে পড়ছে। নির্জন অন্ধকারে এই আলোর উৎস কী, ভাবতে ভাবতে তিনি অজু শেষ করেন। পশ্চিমে মুখ ফিরিয়ে দোয়া পড়ার পর পেছন ফিরে তাকাতেই তিনি বিস্মিত হন। দেখতে পান, হলদে-লাল আগুন লতার মতো আকাশের দিকে বাইছে।
আলী আহম্মদ হতবাক হয়ে ছুটতে থাকেন বাড়ির দিকে। কাছাকাছি যাওয়ার পর তিনি দেখতে পান, তার বসতবাড়িটিই পুড়ে ছাই হচ্ছে আগুন লতায়। ঘরে স্ত্রী আর বুকের দুধ খাওয়া মেয়েটিকে রেখে গিয়েছিলেন। ঘরের দোর আঁটা। হন্যে হয়ে তিনি আগুনে ঝাঁপ দিয়ে দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকেন। তাদের খুঁজতে থাকেন। দেখতে পান, স্ত্রী শিশু মেয়েটিকে বুকে চেপে চৌকির নিচে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। আলী আহম্মদ চিৎকার করে তাদের ডাকেন। কোনো সাড়া পান না। এক পর্যায়ে তিনি টেনে-হিঁচড়ে তাদের বের করেন। কিন্তু ততক্ষণে দুজনেই চিরতরে চোখ বুজেছেন।
আলী আহম্মদ সেদিন আগুন থেকে রক্ষা পেলেও বেঁচে আছেন জীবন্মৃতের মতো। পৃথিবীতে তার কেউ নেই। একা মানুষ। ওই রাতে রাখাইনের বুথিডংয়ে এমন শতাধিক ঘর পুড়েছে মিয়ানমারের সেনাদের ক্রোধের আগুনে।
ভোর হতে না হতে স্কুল শিক্ষক আলী আহম্মদের মতো কয়েক হাজার মানুষ পালিয়ে বাঁচতে ভিড় করেছে নাফ নদীর তীরে। স্বজন হারিয়ে পাথর হয়ে যাওয়া আলী আহম্মদও তাদের সঙ্গে নদী পাড়ি দিয়ে পৌঁছে ছিলেন বাংলাদেশ সীমান্তে। কিন্তু মনটা পড়েছিল বুথিডংয়ের মাটিতে। স্ত্রী-সন্তানকে সমাধিস্থ করার ভাগ্য হয়নি তার। সেনারা পিঁপড়ের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে ঢুকে পড়েছিল লোকালয়ে। বন্দুকের বাঁট আর বেতের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে গ্রাম ছাড়া করেছে তাদের। বাঁটের আঘাত কারো মাথায় পড়েছে। কেউ প্রতিবাদ করতে চাইলে বুলেটে বিদীর্ণ হয়েছে পাজর। রক্তাক্ত হয়ে সেখানেই পড়েছিল নিথর দেহ। কেউ নির্যাতন-নিপীড়নের ক্ষত শরীরে নিয়ে পালিয়ে এসেছে। এদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা বেশি। যারা জঠরে বয়ে এনেছেন সেই নির্যাতন-নিপীড়নের চিহ্ন।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। বিভীষিকাময় পরিক্রমা পার হয়ে যারা বাংলাদেশে এসেছেন, তাদের ঠাঁই হয়েছে কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ অঞ্চলে। উখিয়ার কুতুপালং এখন বিশে^র সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির। সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার হামলা-অভিযোগের ধুয়া তুলে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে নিপীড়ন চালিয়েছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে জাতিগত নিষ্পেষণের এক নির্মম দৃষ্টান্ত। ২৫ আগস্টের পর মাত্র তিন সপ্তাহে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে সোয়া চার লাখ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ। নির্যাতন থেমে থাকেনি। দিনের পর দিন নির্যাতন চলেছে। চলতি আগস্ট মাসেও রোহিঙ্গা এসেছে বাংলাদেশে। এক বছরে এই সংখ্যা সাত লাখ ছাড়িয়েছে। এদের মধ্যে প্রৌঢ়, প্রৌঢ়া আর শিশুদের সংখ্যাও কম নয়।
মানবিক এই বিপর্যয়ে পাশে দাঁড়াতে বাংলাদেশ মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছে। প্রথমে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে কড়াকড়ি মনোভাব রাখা হলেও পরে তা শিথিল হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে বড় ধরনের মানবিক এই বিপর্যয় বুঝতে পেরে সরকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকতে দিয়েছে। আশ্রয় দিয়েছে। খাবার দিয়েছে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবারও কমতি হয়নি। তারপর আস্তে আস্তে আন্তর্জাতিক দাতারাও দাঁড়িয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পাশে।
রোহিঙ্গাদের ঢুকতে দেওয়া বাংলাদেশের জন্য ছিল মাথা পেতে বড় ধরনের সামাজিক ও পরিবেশের বিপর্যয় মেনে নেওয়া। কারণ কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ ছিল দেশের পর্যটন শিল্পের স্বর্গভূমি। রোহিঙ্গাদের সেখানে আশ্রয় দেওয়ায় বিস্তর বনভূমির যেমন ক্ষতি হয়েছে, তেমনি ধ্বংস হয়েছে পাহাড়। সামাজিক অবক্ষয় বেড়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে বিরুদ্ধাচরণ করায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বেড়েছে। এখন পর্যন্ত সরকারি হিসাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কারণে উখিয়া ও টেকনাফের প্রায় ২০ হাজার বর্গ-একর এলাকার পাহাড় ও বন উজাড় হয়েছে। বণ্যপ্রাণী আবাস হারিয়েছে। প্রাণ হারিয়েছে অগুনতি।
রোহিঙ্গাদের বাসস্থানের জন্য বনভূমিসহ প্রায় ছয় হাজার একর জমি বরাদ্দ দিয়েছে বাংলাদেশ।
গত বছরের অক্টোবরে রোহিঙ্গা জনপদের দিনরাত দেখতে গিয়েছিলাম উখিয়া-টেকনাফে। ঘুরে বেরিয়েছি রাজাপালং, পালংখালী ইউনিয়নের শিবিরগুলো। কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গাদের স্থায়ী শিবির ছিল আরও আগেই। ধীরে ধীরে এটি বিস্তৃত হয়েছে বালুখালী, হাকিমপাড়া, জামতল, শফিউল্লার কাটা, গইয়ালমারা, বাঘঘোনা, ময়নাঘোনা, তাজনিমারঘোনা, থ্যাংখালী, মধুরছড়ায়। টেকনাফের প্রকৃতি ঢাকা পড়েছে হোয়াইক্যং, লেদা, উনছিপ্রাং, নয়াপাড়া মুসুনি, হ্নীলার অস্থায়ী শিবিরের কারণে। এসব এলাকার অসমতল ভূমি তাঁবুর শহরে রূপ নিয়েছে। এখানেই গাদাগাদি করে ঠাঁই নিয়েছে বাস্তুহারা মানুষ।
হাটবাজার বলতে আলাদা কিছু নেই। পথে পথে বাজার। পায়ে পায়ে মানুষ। পিঁপড়ের বাসা গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর যেমনটা হয়, মানুষ সেভাবেই ছুটছে। গন্তব্য কারোই জানা নেই। চার চাকার কোনো যান দেখলেই পিছু নিচ্ছে। অসহায় হাত প্রসারিত হচ্ছে ত্রাণের আশায়।
গর্ভবতী মায়েরা মাটির দেয়াল আর পলিথিনের ছাউনি থেকে মুখ বের করে তাকিয়ে আছেন। কেউ এলো কি না তার খোঁজ নিতে। গর্ভ খালাসের অপেক্ষা যেন শেষ হয় না। নাফ নদীর চেয়েও এ পথ দীর্ঘ। অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা চিন্তিত নন। বরং কত তাড়াতাড়ি আলোর মুখ দেখবে গর্ভজাত, সেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দুচোখে। সরকারি হিসাব বলছে, এ পর্যন্ত সাড়ে সাত হাজার শিশু তাঁবুর ফাঁক গলিয়ে আসা আলোর মুখ দেখেছে। শুধু সরকারি সেবাকেন্দ্রের হিসাব এটি। বেসরকারি পর্যায়ে যারা সেবা নিয়েছেন, তাদের সংখ্যাও হাজার ছাড়িয়ে যাবে।
পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট ডেরা দূর থেকে ক্যানভাসের ওপর কালির আঁচড়ের মতো মনে হয়। বিপরীতে চোখে ভাসে মৃত্যুর মিছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘটতে পারে ধস। সেই চিন্তা থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ আবাস গড়ে তুলতে ভাসানচরে উন্নয়ন প্রকল্পও হাতে নিয়েছে সরকার। তবে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো রোহিঙ্গাদের নিজভূমে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করা।
বাংলাদেশ সরকার শুরু থেকেই রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে কূটনৈতিক পর্যায়ে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে মিয়ানমারের ওপর। গত বছরের নভেম্বরে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে মিয়ানমার। ১৬ জানুয়ারি দুই দেশের মধ্যে প্রত্যাবাসন চুক্তি হয়েছে। দুই বছরের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শেষ করার কথা থাকলেও এই চুক্তির কোনো অগ্রগতি নেই। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে সদাসচেষ্ট থাকলেও মিয়ানমারের আগ্রহ কম। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে গত জুন মাসে ইউএনডিপি এবং ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে চুক্তি হলেও তাদের রাখাইন রাজ্যে ঢুকতে নানাভাবে নিরুৎসাহিত করছে মিয়ানমারের সেনারা। তাই প্রত্যাবাসনের এই চুক্তি আদৌ কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
গত ২ জুলাই রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে গেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এবং বিশ^ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম । কথা বলেছেন নির্যাতনের ক্ষত শরীরে বয়ে বেড়ানোর মানুষের সঙ্গে। ভয়াবহ বর্ণনা শুনে আপ্লুত হয়েছেন। শে^তশুভ্র টিস্যুতে চোখ মুছেছেন। মানুষ মানুষকে এভাবে নির্যাতন করে? আন্তোনিও গুতেরেস বিশ^কে ‘ঐক্যবদ্ধ হয়ে’ মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বলেছেন। কিন্তু তাতে কী? মিয়ানমারের টনক কি নড়েছে? আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শুধু রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়াই নয়, নির্যাতনকারী সেনাদের বিচারের দাবি উঠেছে। মিয়ানমার এসবে থোরাই কেয়ার করছে। দেশটির নেত্রী অং সান সু চি শুরু থেকেই শক্ত হয়ে আছেন। শান্তিতে নোবেল পাওয়া এই নেত্রীর ভূমিকা বিশ^জুড়ে সমালোচিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে। জাতিসংঘসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশের অব্যাহত চাপের মধ্যেও সু চি বরাবরই নিজেদের দোষ ঢাকার চেষ্টা করছেন।
গত ২১ আগস্ট সিঙ্গাপুরে এক বক্তৃতায় প্রত্যাবাসন বিষয়ে বাংলাদেশের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করেছেন সু চি। বলেছেন, ‘আমাদের পক্ষে একতরফাভাবে প্রত্যাবাসনের সময় বেঁধে দেওয়াটা খুব কঠিন। কারণ এখানে আমাদের বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে হচ্ছে।’
মিয়ানমার আসলে কী চায়? এখনো রাখাইনে নির্যাতন বন্ধ হয়নি। প্রতিদিনই কমবেশি মানুষ নাফ পাড়ি দিয়ে এদেশে আসছে। ওদিকে প্রত্যাবাসনের বিষয়েও আন্তরিক নয় সু চির দেশ। রোহিঙ্গারাও বলছে, তারা তখনই রাখাইনে ফিরে যাবেন, যখন তাদের সেখানকার নাগরিকের স্বীকৃতি দেওয়া হবে। ফিরিয়ে দেওয়া হবে ফেলে আসা বসতবাড়ি, সহায়-সম্পত্তি। নিরাপত্তা থাকবে। আর কখনো তাদের ওপর এমন বর্বরতা চলবে না, এমন নিশ্চয়তাও তারা চান। এসব চাওয়া নিশ্চিত হলেই কেবল ফিরে যাবেন তারা। মিয়ানমার কি আসলেই এসব দাবি মেনে নেবে? রোহিঙ্গারা কি নিজভূমে নিরাপদ আবাস ফিরে পাবে? এসব প্রশ্ন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সেই সঙ্গে জনঘনত্ব বাড়ছে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে। রোহিঙ্গারা কি আসলেই ফিরবে, নাকি ফিরবে না। সবাই কি আদৌ ফিরতে পারবে? এখন পর্যন্ত যে প্রস্তুতির কথা বলা হচ্ছে, তাতে বিপুল এই জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসন দীর্ঘ সময়ের ফাঁদে আটকে যাবে।
বাস্তবতা হচ্ছে, ১৯৭৮, ১৯৯২ এবং ২০১২ সালে বাংলাদেশে ঢুকে পড়া রোহিঙ্গাদের কাউকেই ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। বরং সর্বশেষ ২০১৭ সালের ঢলে এই সংখ্যা দশ লাখ ছাড়িয়েছে। বিপুল জনগোষ্ঠীর এই জীবন তরি কোথায় ভিড়বে, তা এখনো অনিশ্চিতই বলা যায়।