আজ থেকে ঠিক ২ বছর আগে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মায়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে জাতিগত দাঙ্গার কারণে প্রায় দশ লক্ষাধিক মায়ানমার নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহন করে।দাঙ্গার ঠিক কয়েকদিন পর(২ সেপ্টেম্বর-২০১৭)ছিল মুসলমানদের ২য় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আযহা।সারা বিশ্বের মানুষ তখন পশু কুরবানি নিয়ে ব্যস্ত আর রোহিঙ্গারা তাদের জীবন বাঁচাতে তাদের সহায় সম্বল ছেড়ে নাফ নদী (মায়ানমার ও বাংলাদেশকে বিভক্তকারী নদী) পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ উপকূলে ঝাপ দিচ্ছিল। তখন ছিল বর্ষাকাল থেমে থেমে বৃস্টি হচ্ছিল।নারী,শিশু,বৃদ্ধসহ হাজার হাজার লোক নদীতে লাফিয়ে পড়ে মায়ানমার সামরিক জান্তার হাত থেকে রেহায় পাওয়ার প্রাণান্ত চেস্টা চালাচ্ছিল।প্রথম ১/২দিন বাংলাদেশ সীমান্ত বাহিনী(বিজিবি) তাদেরকে নাফনদীর পাড় অতিক্রমের অনুমতি দেয়নি পরবর্তীতে মানবিক কারণে তাদের সীমানা অতিক্রম করে দেশের ভূখন্ডে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।তারা যে যেখানে পারছে আশ্রয় গ্রহনকরে।কেউ মসজিদে কেউবা স্কুলে কেউবা আবার খোলা জায়গায়।তাদের কেউ কেউ ছিল ৫/৭ দিনের ক্ষুধার্ত অনেকে ছিল অসুস্থ।এই অবস্থায় মানবিক কাজে সর্বপ্রথম এগিয়ে আসেন উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয় জনগন তারা তাদের সাধ্যানুযায়ী রান্না করা খাবার,কাপড়,ঔষধ ও নগদ টাকা ইত্যাদি দিয়ে রোহিঙ্গাদের এহেন দুরবস্থায় তাদের পাশে দাঁড়ায়। নাফ নদী পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকা ডুবিতে অনেকের সলীল সমাধিও হয়েছিল তখন।পরবর্তীতে সেই সব রোহিঙ্গারা কক্সবাজার-টেকনাফ এটিএম জাফর আলম-আরাকান সড়কের উভয় পাশে তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে অবস্থান নিলে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে আগত লোকজন রাস্তার পাশেই তাদের ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করতে থাকে।লক্ষলক্ষ অসহায় ত্রানপ্রার্থী আর হাজার হাজার ত্রাণ দাতাদের বিড়ের কারণে রাস্তায় ভয়াবহ যানঝট শুরু হয়।ফলে রাস্তায় আর্মি নামানো হল,ত্রাণ বিতরণ সুষ্টুভাব সম্পন্ন করার জন্য কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ত্রাণ বিতরণের জন্য ত্রাণ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র খুলল।রাস্তার পাশ থেকে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেওয়া হল পাশ্ববর্তী সরকারী বনভূমিতে। বর্তমানে সেইসব বনভূমিতে (৬০০০ একর) প্রায় ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা বসবাস করছে।পূর্বে এসব বনভূমিতে ছিল স্থানীয় লোকদের মালিকানাধীন সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম।আজ রোহিঙ্গা আগমনের দু'বছর হয়েগেল।দুঃখজনক হলেও সত্য আজ পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও মায়ানমারে ফেরত পাঠানো গেলনা!বর্তমানে বাংলাদেশে কেমন আছে রোহিঙ্গারা?
আবাসন ব্যবস্থাঃ রোহিঙ্গাদের থাকার জন্য প্রতিটা পরিবারের জন্য রাখা হয়েছে আলাদা থাকার ঘর।অধিকাংশ ঘর ত্রিপলের চাউনি ত্রিপলের বেড়া ও মেজে অধিকাংশ পাকা করানো।যদিও কোন কোন ক্যাম্পে দাতা সংস্থার ডিজাইন অনুযায়ী সনের চাউনির ঘরও বিতরণ হয়েছে।পরিবারের সদস্য সংখ্যানুপাতে ব্যবস্থা করা হয়েছে স্বাস্থাসম্মত পায়খানার।সকলের জন্য নিশ্চিত করা হয়েছে সুপেয় নিরাপদ পানির।
খাদ্যঃ পরিবারের সদস্য অনুপাতে মাসিক চাহিদা নিরুপন করে বিতরণ করা হচ্ছে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী।খাদ্য সামগ্রী এর মধ্যে রয়েছে চাল,ডাল,তেল,লবণ,মসলা,ডিম,আলু সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র।খাদ্য সামগ্রীর পাশাপাশি নিয়মিত দেওয়া হয় সাবান,শ্যাম্পু,সেনিটারি ন্যাপকিন,হুইল পাউডার সহ নানাবিধ পরিচ্ছন্নতা সামগ্রী।
চিকিৎসাঃ রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা দেবার জন্য রয়েছে বিভিন্ন সুবিধা সম্বলিত স্বাস্থ্য সেবা কেনদ্র।তার পাশাপাশি বাড়ি পর্যায়ে অসুস্থ ও অপুষ্ট রোগী সনাক্তকরণের জন্য রয়েছে আলাদা আউটরীচ কর্মী বাহিনী। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে উন্নত চিকিৎসাসেবাও নিশ্চিত করা হয়েছে সমগ্র ক্যাম্প এলাকায়।কোন কোন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র খোলা থাকে ২৪ ঘন্টা ৭ দিন।এসব হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা প্রদান করছেন দেশি বিদেশী অভিজ্ঞ চিকিৎসাগণ।নারী ও শিশুদের অগ্রাধিকার দিয়ে স্হাপন করা হয়েছে"মা ও শিশু হাসপাতাল"। পুষ্টিসেবা নিশ্চিত করার জন্য রয়েছে আলাদা পুষ্টিসেবা কেন্দ্র। প্রতিটা চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রে রয়েছে মানসিক ও মনোসামাজিক সাপোর্ট কেন্দ্র। জটিল ও মারাত্মক রোগীদের জেলা সদর হাসপাতালে রেফার করার জন্য রয়েছে সার্বক্ষনিক এম্বুলেন্স ব্যবস্থা।
শিক্ষাঃ রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত সংখ্যক লার্নি সেন্টার।এসব লার্নিং সেন্টারে নিয়োগকরা হয়েছে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক শিক্ষিকা। রোহিঙ্গা শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য প্রায় প্রতিটি শিখন কেন্দ্রে রয়েছে পর্যাপ্ত খেলনা সামগ্রী ও বিনোদনের ব্যবস্থা।পাঠদানরত শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত আয়োজন করা হয় বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের।ঝরে পড়া রোধকরার জন্য পরিচালিত হয় আউটরিচ কার্যাবলি।
বস্ত্রঃ জীর্ণ শির্ণ বসনের রোহিঙ্গা এখন আর চোখে পড়েনা।তাদের হাতে পর্যাপ্ত পয়সা যোগ হওয়ায় তারা তাদের পছন্দ অনুযায়ী পরিধেয় ব্যবহার করছেন।ক্যাম্পের ভিতরেই মিলে বার্মার ঐতিহ্যবাহী থামি,লুঙি ও কামিজের।
আয় ইনকামঃ ধারণা করা হয় বর্তমানে প্রায় প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারেই কোন কোন সদস্য নিয়মিত আয়বর্ধক কাজে সম্পৃক্ত।তাদের আয়ের বড় উৎস হল দিনমজুরি,ক্যাম্পের ভিতরে আর বাইরে তাদের অধিকাংশলোক দিনমজুরির কাজ করে দৈনিক ৪০০/৫০০ টাকা আয় করতে পারেন।তাড়াছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভিতরে গড়ে উঠা হাজারো দোকানের মালিকানাও রোহিঙ্গাদের হাতে।সবজি,পান,মাছ মাংস, প্রসাধনী সব দোকানই রোহিঙ্গারা পরিচালনা করে থাকে।তার পাশাপাশি তাদের দেয় ত্রাণের কিছু অংশ তারা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে প্রতিমাসে আয় করেন অনেক টাকা।রোহিঙ্গা নারী পুরুষদের অনেকে বিভিন্ন সেবা সংস্থায় কাজ করে ভালো বেতন অর্জন করে থাকেন।তাদের আয়ের বর্ধিত অংশ তারা স্বর্ণে বিনিয়োগ করে থাকেন।ফলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আনাচে কানাচে গড়ে উঠেছে শতশত জুয়েলারি দোকান।কেবল বালুখালী পানবাজার থেকে বালুখালী ক্যাম্প পর্যন্ত স্থানে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক স্বর্ণের দোকান।অনেকে ঐ স্থানকে রোহিঙ্গাদের "বায়তুল মোকাররম (ঢাকার বৃহত্তম স্বর্ণবাজার) " কিংবা চট্টগ্রামের "দিদার মার্কেট"(চট্টগ্রামের প্রাচীন স্বর্ণবাজার) বলে আখ্যায়িত করেন।কেউ কেউ ইতিমধ্যে তাদের অর্জিত টাকায় হাসমুরগী ও পশুপালনের মত কাজের দিকেও ঝুঁকছে।বিগত দু'বছরে (২০১৭-২০১৯) রোহিঙ্গাদের সামগ্রিক যে অগ্রগতি হয়েছে তা তাদের মাতৃভূমি মায়ানমারে বিগত দু'শ বছরেও হয়নি বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন।অবস্থাদৃষ্টি যে কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে এসব সুযোগসুবিধা বিসর্জন দিয়ে এই রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরে যেতে আদৌ রাজি হবেন কিনা?প্রত্যাবাসন ব্যবস্থা তরান্বিত করার জন্য দেশের সকল মহলকে নিজনিজ অবস্থান থেকে জোরালো ও কার্যকর ভূমিকা রাখার উপযুক্ত সময় চলে আসছে।নচেৎ এই রোহিঙ্গা ইস্যু শীঘ্রই বাংলাদেশের জন্য একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
লেখকঃ
জিয়ার রহমান মুকুল
মানবিক ও উন্নয়ন কর্মী
শেড,কক্সবাজার।
ইমেলঃ [email protected]