রফিকুল ইসলাম ::
মোঃ জাফর। উখিয়ার কুতুপালং মেগা ২-ইষ্ট ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের চেয়ারম্যান বা ক্যাম্প হেড মাঝি। অভিযোগ আছে সে মিয়ানমারের নিষিদ্ধ আলেখিন বা আরসা সন্ত্রাসী সংগঠনের একজন সক্রিয় নেতাও। সে ২০১৭ সালে অন্য লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিলেও ইতিমধ্যে বানিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশী এনআইডি।
জাফর আলম ২০১৯ সালে বাংলাদেশী জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি বানিয়ে নেয়। তাও আবার স্মার্ট কার্ড। যা দেশের অধিকাংশ নাগরিকরা এখনো পায়নি। চট্টগ্রামের রাংগুনীয়ার পোমরা কাদেরীয়া পাড়ার ঠিকানায় বানানো তার এনআইডি নং- ৭৭৭৭৮৩৬৩৮৩।
মোঃ তৈয়ব, ২০১৯ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা আশ্রিত হিসেবে ঝঞঔ- ০০১৮৩২৯৫ নং নিবন্ধিত হয় উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয় ক্যাম্পে। জন্ম ৫ এপ্রিল ১৯৯৬ মিয়ানমারে। পিতা আবু শামা, মাতা ফাতেমা খাতুন। সুচতুর তৈয়ব শুধুমাত্র নিজের নাম মোঃ খালিদ হোসেন পাল্টিয়ে মা, বাবা, জন্মসাল সব ঠিক রেখে পরের বছর চট্টগ্রাম সিটির হালিশহর এলাকায় ৩৩০২৫৪৮৩৫৩ নং স্মার্ট কার্ড বানিয়ে নেয়। ইতিপূর্বে ২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে ইঔ০৫৩৬৭২৪ পাসপোর্ট করে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন এনজিওতে কর্মরত কক্সবাজার জেলার বাইরের বাসিন্দা একশ্রেণির কর্মীরা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের এনআইডি ও পাসপোর্ট প্রাপ্তিতে সহায়তা প্রদান করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
উখিয়ার ১৩নং তাজনিমারখোলা ক্যাম্পের নিবন্ধিত সবধরনের সুবিধাভোগী রোহিঙ্গা মোঃ আলী। সেও একটি রোহিঙ্গা উগ্রবাদী সংগঠনের উল্লেখযোগ্য নেতা। সে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার ৩ বছরের মধ্যে বানিয়ে নিয়েছে এনআইডি। তাও আবার স্মার্ট কার্ড।
উখিয়ার ১৪নং হাকিমপাড়া ক্যাম্পের রোহিঙ্গা ফয়েজুল কবির। সে ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়ার কয়েক মাসের ব্যবধানে করে নেয় বাংলাদেশী পাসপোর্ট। ২০১৮ সালের ৯ জানুয়ারী চট্টগ্রামের লোহাগড়া উপজেলার পদুয়ার মাস্টারপাড়া ঠিকানায় ইজ ০৪৪২২০৯ নং পাসপোর্ট করে নেয়। তার নাম পাল্টিয়ে পাসপোর্টে নাম দেয় মোঃ ইকবাল চৌধুরী। বর্তমানে সে বালুখালী ৯ নং ক্যাম্পের 'বি-৮' বøকে থাকে বলে জানা যায়।
অভিযোগ আছে সে আরসা সন্ত্রাসী সংগঠনের সামরিক ও ফিন্যান্স বিভাগের হর্তাকর্তা। ২০১৮ সালেই সে আরসা হয়ে ফান্ড সংগ্রহে সৌদি আরব চলে যায়। সৌদি থেকে ২০১৯ সালের শেষার্ধে বাংলাদেশে ফেরার সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হয়েছিল। কিন্তু বেশীদিন জেলে কাটাতে হয়নি তাকে। জামিনে বেরিয়ে সে আরসার নীতিনির্ধারকের একজন হয়ে দায়িত্ব পালন করছে বলে রোহিঙ্গারা জানান।
এছাড়াও বাংলাদেশী হতে যা যা প্রয়োজন সবকিছু মিলছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে! গত ২০ জুলাই বিকেল ৫টার দিকে ৮ এপিবিএন পুলিশ অভিযান চালিয়ে উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া ১/ডবিøউ ক্যাম্প হতে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশী বানাতে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস তৈরী চক্রের পাঁচ সদস্যকে বিপুল পরিমাণের সরঞ্জামসহ আটক করে।
উখিয়া ৮ এপিবিএন এর কমান্ডিং অফিসার মোহাম্মদ সিহাব কায়সার খান পিপিএম জানান, উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পের মোঃ আবদুল্লাহ (৩৭) এর বসতঘরে অভিযান পরিচালনা করে তাকে আটক করা হয়। এসময় এ চক্রের আরো ৪ জনকে আটক করা হয়।
এসময় আটককৃত রোহিঙ্গা আবদুল্লাহর ঘর তল্লাশী করে ৪ টি ল্যাপটপ, ৮ টি স্মার্টফোন, ৪টি পেনড্রাইভ, ২ টি স্ক্যানার ও প্রিন্টার, ২৮ টি অনলাইন ডুপ্লিকেট জন্ম নিবন্ধন রেজিষ্ট্রেশন, ১১ টি জন্ম নিবন্ধন তথ্য যাচাই ফরম, ৩০ টি ডুপ্লিকেট জন্মসনদ, ২০টি ডুপ্লিকেট এনআইডি, ২০০টি বিভিন্ন ব্যক্তির এনআইডির ফটোকপি, সোনালী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংকের চেক বই ও জমা ¯িøপ বই, ৫টি সিল, ১টি সমবায় সমিতির নিবন্ধন সনদ পত্র, ২০ টি শাহপুরি বাস্তহারা আদর্শ গ্রাম সমবায় সমিতি লিঃ এর সদস্য ফরম, ব্যাংকে জমা দেওয়ার ৩৫ টি পাশ বহি।
এসময় উখিয়ার ৪ নং রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের প্রদত্ত ৮টি ট্রেড লাইসেন্স, যেগুলো রোহিঙ্গা জালিয়াতকারী আবদুল্লাহ নামে লিপিবদ্ধ, ৪নং রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের ইস্যুকৃত জাতীয়তা সনদপত্র ৬ টি, ভূমিহীন সনদ ৫ টি, আবদুল্লাহ নামে বিদ্যুৎ বিলের কাগজ পত্র, বিভিন্ন ধরণের জায়গা জমির দলিল ও খতিয়ান, মোঃ ইসমাইলের জন্ম সনদ ও আইডি কার্ড, মোঃ ত্বালহা এর নামে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকার স্মার্ট কার্ড ও জাতীয়তা সনদ, জন্ম সনদ ও মোঃ হারুন এর জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি জব্দ করা হয়।
৮ এপিবিএন এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মোঃ কামরান হোসেন জানান, প্রাথমিকভাবে জানা যায়, উক্ত চক্রটি দীর্ঘদিন থেকে সাধারণ রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে নকল বাংলাদেশী জাতীয় পরিচয় পত্র, জন্ম নিবন্ধন ও পাসপোর্ট তৈরি করে দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ অবৈধভাবে হাতিয়ে নিচ্ছে।
জানা যায়, চলমান ভোটার অন্তর্ভূক্তিতে ব্যাপক আকারে সাধারণ রোহিঙ্গারা যাতে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ, বিদেশে গমনের জন্য পাসপোর্ট তৈরির লক্ষ্যে উক্ত দালাল চক্রকে মোটা অংকের টাকা প্রদান করে। এসবের পিছনে অর্থ ও অনান্য সুযোগ সুবিধা প্রদানে একাধিক চক্র ইন্ধন যুগিয়ে আসছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
কুতুপালং পুরাতন নিবন্ধিত ক্যাম্পের রোহিঙ্গা শরণার্থী হামিদ হোসাইন সম্প্রতি স্মার্ট কার্ড বানিয়ে নিয়েছে। কক্সবাজার সদর উপজেলার ইসলামপুরের ঠিকানায় করা তার এনআইডি নং ৭৩০১৯৩১৯৮১। সে কুতুপালং রেজিস্ট্রার্ড ক্যাম্পের 'বি' বøকের সুলতান আহমদের ছেলে। ১৯৯২ সালে মিয়ানমার থেকে আসা ঐ রোহিঙ্গার শরণার্থী নিবন্ধন বা এমআরসি নং ২৮৪০৯।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, অসৎ জনপ্রতিনিধিদের কারণেই রোহিঙ্গারা এনআইডি পেয়ে যাচ্ছে। আর তা দিয়ে অনেকে ভোটারও হয়ে পড়ছে। জানা গেছে, কিছু জনপ্রতিনিধি ও ইসির একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী যোগসাজশ করে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের ভোটার বানাচ্ছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও ইসির প্রতিবেদনেও এ তথ্য উঠে এসেছে।
সরকারের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, বিশেষ করে ভোটার হওয়ার আগে রোহিঙ্গারা কীভাবে অনলাইনে জন্মসনদ এবং চেয়ারম্যান-কাউন্সিলর থেকে নাগরিকত্ব সনদ পাচ্ছে তার তদন্ত জরুরি। রোহিঙ্গাদের ভোটার করতে চট্টগ্রাম অঞ্চলের একাধিক শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত রয়েছে বলে তথ্য পেয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
এরই মধ্যে এসব ঘটনায় জড়িত ইসির বর্তমান ও সাবেক প্রায় ৩০ কর্মচারীকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। চক্রটি চট্টগ্রাম অঞ্চলে সুবিধা করতে না পারলেও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে রোহিঙ্গাদের ভোটার করছে। ভোটার হতে হলে চট্টগ্রামের বিশেষ এলাকার বাইরে একজন ভোটারকে জন্মসনদ বা সার্টিফিকেট, নাগরিক সনদ, বাবা-মায়ের এনআইডি, বাসার ইউটিলিটি বিলের কপি জমা দিতে হয়।
চট্টগ্রাম ছাড়াও কুমিল্লা, ঢাকা, গাজীপুর, রাজশাহী, রংপুর, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিদ্যমান ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা আশ্রিত রোহিঙ্গারা। নতুন ও পুরাতন নিবন্ধিত রোহিঙ্গারাও ভোটার হয়ে যাচ্ছে। সারাদেশে ইসির সতর্কতাও কাজে আসছে না।
এসব কাগজপত্র তৈরি করার ক্ষেত্রে মোটা অংকের কন্ট্রাকে রোহিঙ্গাদের সহায়তা করে থাকে সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট মাঠপর্যায় থেকে ইসির সচিবালয় পর্যন্ত সক্রিয়। নতুন ভোটার করার পর ইসির কাছে সংরক্ষিত ১১ লাখ ২২ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ডাটাবেজ যাচাই-বাছাই করা হয়। আগামী ১ আগষ্ট থেকে উখিয়া উপজেলায় ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হচ্ছে বলে জানান উখিয়া উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোঃ ইরফান।
নির্বাচন কর্মকর্তা জানান, ইতিমধ্যে ভোটার নিবন্ধন কর্মকাÐের সাথে সংশ্লিষ্টদের রোহিঙ্গাদের ভোটার নিবন্ধনের ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এসব নীতিবাক্য কোন সময় কাজে আসেনি, এবারও তাই হওয়ার আশংকা অনেকের।
উখিয়া সুজন সভাপতি নুর মোহাম্মদ সিকদার বলেন, আমরা সাধারণ নাগরিকরা এ নিয়ে চিল্লাচিল্লি করেও কোন কাজ হচ্ছে না। উখিয়া সাংবাদিক ফোরাম সেক্রেটারি গফুর মিয়া চৌধুরী বলেন, উখিয়ায় উল্লেখযোগ্য একটি অংশ মিয়ানমার নাগরিক রোহিঙ্গা। তারা এদেশের নাগরিকত্ব, এনআইডি যা যা প্রয়োজন সবই আয়ত্তে নিয়েছে। আগামীতে যে নেবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে বলে তিনি প্রশ্ন তোলেন।
রোহিঙ্গা ভোটার ঠেকাতে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি জেলার ৩২ বিশেষ এলাকা ছাড়াও সারাদেশে রোহিঙ্গাদের ভোটার না করার ব্যাপারের কঠোর নজরদারির নির্দেশ দিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। কিন্তু চক্রটি এতই শক্তিশালী যে ইসির নির্দেশনার পাশাপাশি রোহিঙ্গা ডাটাবেজকেও ব্যর্থ করে দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ভোটার করতে দেড়- দুই লাখ টাকার লেনদেন হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
কিন্তু সিন্ডিকেট সদস্যদের সহায়তায় ইসি ঘোষিত ৩২টি বিশেষ উপজেলার বাইরে গিয়ে ভোটার হচ্ছেন রোহিঙ্গারা। কারণ ৩২ বিশেষ এলাকায় ভোটার হতে অন্তত ১৩-১৭ ধরনের সত্যায়িত প্রমাণাদি আবেদন ফরমের সঙ্গে জমা দিতে হয়। এক্ষেত্রে ৩২ বিশেষ এলাকার বাইরে রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
রোহিঙ্গারা সবচেয়ে বেশি ভোটার হয়ে থাকে চট্টগ্রাম সিটি ও চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন উপজেলাগুলোর ঠিকানায়। চট্টগ্রামের একটি থানা নির্বাচন অফিসে তদন্তে এক এলাকার ফরমে অন্তত ১৪টি থানায় রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়।
এছাড়াও প্রথম হালনাগাদে সীমান্তবর্তী বিভিন্ন উপজেলার ৫০ হাজারের মত রোহিঙ্গা ভোটার শনাক্ত হয়। উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের পর ৪২ হাজার রোহিঙ্গা ভোটারের নিবন্ধন বাতিল করা হয়। ২০১২ সালেও কয়েকটি এলাকায় রোহিঙ্গা ও অবৈধ নাগরিকের অভিযোগে ১৭ হাজার রোহিঙ্গাকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয় কমিশন। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সুপারিশে ৯৮ জন রোহিঙ্গাকে ভোটার তালিকা থেকে কর্তন করা হয়