ডেস্ক রিপোর্ট ::
জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ বলে গণ্য হতে পারে—এমন আশঙ্কা প্রকাশের পর দেশটি বড় ধরনের আন্তর্জাতিক চাপে পড়েছে। জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনের বিভিন্ন অংশের প্রতিবাদ জানানোরও প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশটি। জানা গেছে, ‘রোহিঙ্গা’ শব্দের ব্যবহার নিয়েই মিয়ানমার ক্ষুব্ধ। দেশটি গত সপ্তাহে নতুন এক আদেশ জারি করেছে, যেখানে রোহিঙ্গাদের ‘ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী’ বলে ডাকতে হবে। একইভাবে রাখাইনদের ‘বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী’ বলে ডাকার আদেশ দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি মিয়ানমারের কাছে স্পর্শকাতর। বাংলাদেশ সরকারি পর্যায়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বৈঠকে ও যোগাযোগের সময় রোহিঙ্গা বোঝাতে ‘মিয়ানমারের নাগরিক’ হিসেবে উল্লেখ করে থাকে। সম্প্রতি বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত নয় এমন রোহিঙ্গাদের জরিপের সময়ও তাদের ‘মিয়ানমারের নাগরিক’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, মিয়ানমারের নতুন সরকার দেশটির রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের সমস্যা দ্রুত সমাধানে আশাবাদী না হলেও রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে কৌশলগত কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর একটি হলো, রাখাইন প্রদেশের জনগোষ্ঠীগুলোকে তাদের নৃগোষ্ঠীগত পরিচয়ে না ডেকে ধর্মীয় পরিচয়ে ডাকা। রাখাইন প্রদেশের রাখাইনরা রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ বলে সম্বোধন করত। প্রকারান্তরে বোঝানো হতো যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নয়, তারা বাংলাদেশ থেকে সেখানে গেছে। এমন ধারণা সঠিক নয় বলে বাংলাদেশ তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বলেছে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারেরই নাগরিক। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের নতুন সরকার রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ বলা থেকেও সরে এসেছে। রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের হলেও এর বড় প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশে। এ দেশের কক্সবাজারে দুটি শরণার্থীশিবিরে মিয়ানমারের প্রায় ৩২ হাজার শরণার্থীর বাইরে বিপুলসংখ্যক অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা রয়েছে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে অব্যাহতভাবে যোগাযোগ রাখলেও তাদের প্রত্যাবাসনে তেমন কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। মিয়ানমারের নতুন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের কাজ করার আগ্রহের বার্তা নিয়ে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হকের এ মাসেই নেপিডো সফরের কথা রয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার পর রোহিঙ্গা ইস্যুই বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কে বড় বাধা। বাংলাদেশ এ বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাবে। পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষেত্রেও জোরালো সম্পর্ক গড়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। গত বছর জুলাই মাসে কাউন্সিলের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার জায়িদ রা’দ আল হোসেইন গত সোমবার জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে মিয়ানমারের মুসলমান রোহিঙ্গা ও অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিস্থিতি তুলে ধরেন। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের শিকার। বিশেষ করে, তারা নাগরিকত্ব, চলাচলে স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অধিকার নেই। তাদের দিয়ে জোর করে কাজ করানো হয়। তারা যৌন সহিংসতার শিকার। তাদের কোনো রাজনৈতিক অধিকারও নেই। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যে উগ্র জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হামলার চার বছর পরও প্রায় এক লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা ও কামান সম্প্রদায়ের মুসলমান আশ্রয়শিবিরে রয়েছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতার মাত্রা এত ব্যাপক যে তা মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার জায়িদ রা’দ আল হোসেইন বলেন, ‘নতুন সরকার এমন একটি পরিস্থিতিতে ক্ষমতায় এসেছে যেখানে সংখ্যালঘুদের মৌলিক অধিকার প্রত্যাখ্যানের লক্ষ্যে আইন ও নীতি রয়েছে এবং এসব সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গুরুতর সহিংসতার দায়মুক্তি নতুন করে সহিংসতা চালাতে তাদের উৎসাহিত করেছে।’ জায়িদ রা’দ বলেন, এসব বৈষম্য থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়। এটি একটি চ্যালেঞ্জিং প্রক্রিয়া। মিয়ানমারের ধর্মীয় ও নৃগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে চলমান সহিংসতা ঠেকানো ও নতুন করে সহিংসতা এড়ানোই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।