#স্থানীয়করণ- ০২
রেজাউল করিম চৌধুরীঃ
আমার প্রথম রচনায়, আমি স্থানীয়করণ কী তা বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি এবং জাতিসংঘ প্রক্রিয়াগুলো এই কথাগুলোই বলেছে। স্থানীয়করণের এই ধারণা বা চেতনাটি সহজেই আসেনি; তৃতীয় বিশ্বের বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার, বিভিন্ন অংশীজন এবং বিশেষত জাতিসংঘের কিছু আন্তরিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলেই অর্থ সাহায্যের স্থানীয়করণের এই ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমি মূলত মানবিক ও উন্নয়ন সহায়তার দৃষ্টিকোণ থেকেই স্থানীয়করণকে বর্ণনা করেছি।
তবে এটিকে আমাদের অধিকার হিসাবে বিবেচনা করতে হবে, ধনী দেশগুলোর উদারতা হিসেবে নয়। মন্টেরেরি কনসেন্সাস (২০০২), প্যারিস ডিক্লেরেশন অন এইড ইফেকটিভনেস (২০০৫), আকরা এজেন্ডাস ফর অ্যাকশন (২০০৮), বুশান পার্টনারশিপ ফর ইফেকটিভ ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন (২০১১), নাইরোবি ডিক্লেরেশান অন ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন (২০১৬) শীর্ষক নানা বৈশ্বিক সম্মেলনের মাধ্যমে উন্নয়ন সহায়তার কার্যকারিতার (Aid Effectiveness) ধারণার বদলে কার্যকর উন্নয়নের (Development Effectiveness) ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর এর মাধ্যমে উন্নয়ন সহযোগিতাকে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এই সমস্ত সম্মেলনগুলি আয়োজন করেছে জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংস্থা ও বিশ্ব ব্যাংকের মতো বহুপাক্ষিক আর্থিক সংস্থাসমূহ, এসব ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণের ধারণা এবং সরকারের মালিকানা পুরোপুরি স্বীকৃত হয়েছে।
ধনী দেশগুলির নাগরিক এবং রাজনীতিবিদরা চান যে সমস্ত উন্নয়ন ও মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে সহায়তা গ্রহীতা দেশগুলোর মালিকানা এবং তাদের কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে এবং দেশগুলো সংকট মোকাবেলা বা উন্নয়ন চাহিদা পূরণে ধীরে ধীরে পরনির্ভরতা কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে। এটি লক্ষ করা উচিত যে, এই স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির বেশিরভাগই ঔপনেবেশিক শক্তিগুলোর অধীনে ছিলো এবং এখনও ধনী দেশগুলি তাদের অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণের বোঝা চাপাচ্ছে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপর। কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী না হয়েও স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। এজন্য উন্নত দেশগুলোর একটি ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা (Historical Responsibilities) রয়েছে। আমি এই কারণেই ধনী দেশগুলোর অর্থ সহযোগিতাকে আমাদের অধিকার হিসেবে অভিহিত করতে চাই এর কারণ এটিকে যখন আমরা আমাদের অধিকার হিসেবে বিবেচনা করবো, তখন এই অর্থ সহযোগিতা বাস্তবায়নের সময় এর তদারকির দায়িত্বও আমাদের নিতে হবে, এই বিষয়ে আমাদের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা প্রয়োজন।
কক্সবাজারের সাধারণ জনগণ জেলায় বৈদেশিক অর্থ সাহায্যের বিপুল আগমনের মূল্য পরিশোধ করছে প্রয়োজনীয় প্রায় সব কিছুরই প্রায় ৩৫% মূল্যবৃদ্ধির ভার সহ্য করার মাধ্যমে। আমরা হিসাব করে দেখেছি, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর অবধি প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারের জন্য প্রতি মাসে ৪৪১ ডলার, অর্থাৎ ৩৭,০৪৪ টাকা করে এসেছে, এটি সর্ভমোট প্রায় ২.৫ বিলিয়ন ডলার, বা ২১ হাজার কোটি টাকা। তবে পুরো এই অর্থের সুযোগ-সুবিধা রোহিঙ্গা পরিবারগুলো পেয়েছে কিনা তা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন আছে।
গ্র্যান্ড বার্গেইন (জিবি) প্রতিশ্রুতিমালার স্টিম ১ বা এইড ট্রান্সপারেন্সি (সহায়তার স্বচ্ছতা)-এর পরিপ্রেক্ষিতে সিসিএনএফ সবসময় রোহিঙ্গা ত্রাণ কর্মসূচিতে কর্মসূচি বাস্তবায়নে কত খরচ, রোহিঙ্গাদের জন্য সরাসরি কত খরচ, বিদেশি বিশেষজ্ঞ নিয়োগে খরচ কত আর পরিচালনা ব্যয় কত-সেই বিষয়ে তথ্য প্রকাশের দাবি করে আসছি। আমরা রোহিঙ্গা ত্রাণ কর্মসূচিতে গণ- নজরদারির বা স্থানীয় জনসাধারণের অংশগ্রহণের দাবি করে আসছি, স্থানীয় জনগণ কিভাবে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে খরচ কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারে। খরচ কমানোটা কমিয়ে আনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সামনের দিনেগুলোতে অর্থ সহায়তা কমে গেলে কম ব্যবস্থাপনা খরচ দিয়েই রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর জন্য আরও বেশি সেবা দিতে হবে।
প্রাক্তন পররাষ্ট্রসচিব একবার বলেছিলেন যে জাতিসংঘের এজেন্সিগুলির ব্যবস্থাপনা বা পরিচালন ব্যয় প্রায় ৬৫%। টিআইবির একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, জাতিসংঘের কোন কোন সংস্থা প্রায় ৩১% পরিচালন ব্যয় করছে। যেহেতু জাতিসংঘ অঙ্গসংস্থাগুলো উচ্চ বেতনে কর্মী নিয়োগ করে, যেহেতু জাতিসংঘসহ অনেক অান্তর্জাতিক এনজিও এখানে এসেছে, কক্সবাজারে স্থানীয় এনজিওদের কর্মীদের বেতন প্রায় ২০০% বেশি হয়ে গেছে। স্থানীয় এনজিওগুলি প্রায় ৪০০ কর্মী হারিয়েছে, ভবিষ্যতে স্থানীয় /জাতীয় এনজিওগুলোর টিকে থাকাই কঠিন হযে পড়ছে। কক্সবাজারে জাতিসংঘের সমস্ত সংস্থা এবং আইএনজিওগুলি উপ-অফিস স্থাপন করেছে, সাধারণ সময়ে প্রতিদিন কক্সবাজার এবং ঢাকার মধ্যে যেখানে ৫/৮টি ফ্লাইট থাকে, সেখানে কক্সবাজারে এত অফিস থাকা কি আদৌ প্রয়োজন আছে?
কক্সবাজারে জাতিসংঘের প্রায় অঙ্গসংস্থার অফিস আছে, আইএনজিওদেরও এ ধরনের অফিস রয়েছে। কক্সবাজার থেকে উখিয়া প্রতিদিন যাতায়াত করা ব্যয়বহুল, প্রায় ৯০মিনিটি সময় লাগে এতে। সবমিলিয়ে প্রতিদিন কক্সবাজার-উখিয়া যাওয়া আসাতে প্রায় ৪ ঘণ্টা সময় লেগে যায়, আর প্রতিদিনই উখিয়ায় যানবাহনের চাপে যানজট লেগে যায়। প্রতিদিন প্রায় ২০০-৩০০ গাড়ি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাতায়াত করছে। কক্সবাজার শহরের জন্যও এটি অতিরিক্ত চাপ তৈরি করছে। অথচ কক্সবাজার থেকে বিভিন্ন সংস্থার কর্মীদের জন্য শাটল বাসের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অন্যদেশের মতো, রোহিঙ্গা কর্মসূচিকে সম্পৃক্ত সংস্থাগুলোর কর্মীবৃন্দের উচিত্ ক্যাম্পের আশপাশে, উখিয়ায় বসবাস করা। ক্যাম্পের আশপাশে তারা থাকলে রোহিঙ্গারা আরও বেশি সেবা পেতে পারে, আর এতে করে ভ্রমণ ব্যয়ও ব্যাপকভাবে কমে যাবে।
জাতিসংঘ প্রতিবছর তাদের যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনা বা জেআরপি প্রকাশের সময় সিসিএনএফ বিভিন্ন গণ-অনুষ্ঠানে এসব প্রস্তাব পেশ করে আসছে।
-রেজাউল করিম চৌধুরী
নির্বাহী পরিচালক, কোস্ট ট্রাস্ট।