উদিসা ইসলাম
মার্চের শুরুতে কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন বাস্তবসম্মত নয় বলে মন্তব্য করেছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবসন কমিশনার মিজানুর রহমান। তিনি মনে করেন, ক্যাম্পের বিষয়ে যে সুপারিশগুলো কমিটি দিয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব। এসব সুপারিশ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ কবে কীভাবে নেওয়া হবে সে বিষয়েও তিনি এখনও অবহিত নন। সেটি জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে আসবে। তবে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।
গত ৫ মার্চ বিকালে উখিয়ার বালুখালী ১১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ সময় আগুন দ্রুত পার্শ্ববর্তী ৯ এবং ১০ নম্বর ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়ে। তিন ঘণ্টা পর সন্ধ্যা ৬টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস। এ ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসন। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু সুফিয়ানকে প্রধান করে এ কমিটি করা হয়। কমিটিতে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের প্রতিনিধি, এপিবিএন, জেলা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের প্রতিনিধিরা ছিলেন।
কমিটি ১২ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মামলা, নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান ও গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোসহ ১২টি সুপারিশ করা হয়। সুপারিশের মধ্যে আরও রয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রতিটি ব্লকের রাস্তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি চলাচল উপযোগী করা, ব্লকের রাস্তার পাশে পানির চৌবাচ্চা তৈরি, আশ্রয়কেন্দ্রে ত্রিপলের পরিবর্তে ভিন্ন কিছু ব্যবহার; যা অপেক্ষাকৃত কম দাহ্য পদার্থের তৈরি, ক্যাম্পের জন্য পৃথক ফায়ার সার্ভিস ইউনিট গঠন, ক্যাম্পের অভ্যন্তরে যত্রতত্র মার্কেট করা থেকে বিরত ও বড় রাস্তার পাশ ছাড়া অন্য স্থানে দাহ্য পদার্থ আউটলেট করা থেকে বিরত থাকা, ঘনবসতিপূর্ণ ও অনেক স্থানে যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে ক্যাম্পের প্রবেশমুখে লে-আউট স্থাপন, আগুন লাগলে নেভানোর কাজে রোহিঙ্গাদের অংশ নেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা তৈরি, ক্যাম্পের ব্লকে ব্লকে ওয়ারলেস টাওয়ার স্থাপন ও ৩৬০ ডিগ্রি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন এবং এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে পালানো রোধে নিরাপত্তাবেষ্টনী স্থাপন করা।
তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন বিষয়ে পদক্ষেপ কী জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে জমা হয়েছে। আমি শুনেছি, কিন্তু এর কোনও ফলোআপ করণীয় লিখিত আসেনি, ফলে বিস্তারিত জানি না।’
তবে এমন কোনও পরামর্শ দিয়ে লাভ নেই যেটা বাস্তবসম্মত নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সুপারিশগুলো যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা ভেবে নিয়ে দেওয়া না হয়। কোনও সভ্য দেশের নাগরিক হিসেবে ভাবলে এসব সুপারিশ কার্যকর করা যায় না। সুপারিশে বলা হয়েছে ক্যাম্পের রাস্তাগুলোতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যেন যেতে পারে। সেটা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত না। যারা ক্যাম্পে গেছেন তারা বিষয়টি বুঝতে পারবেন। ৮ হাজার একর জায়গার মধ্যে ১০ লাখ লোক রাখবেন। তার ওপর এলাকাটি পাহাড়ি। এরমধ্যে আপনি কীভাবে এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করবেন? কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে কারাগারের মতো করে ফেলার সুযোগও আপনার হাতে নেই। ফলে এগুলো খুব সহজ নয়।’
তারচেয়ে আগুনের কারণ চিহ্নিতকরণ জরুরি
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত দুই বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় মোট ২২২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৬৩টি আগুন নাশকতামূলক বা ইচ্ছে করে লাগানো হয়েছে। ৯৯টি অগ্নিকাণ্ড দুর্ঘটনাজনিত কারণে হয়েছে আর ৬৩টির কারণ জানা যায়নি। মানবাধিকারকর্মী ও অভিবাসন বিশ্লেষকরা বলছেন, সবার আগে আগুনের কারণ বের করতে হবে।
বালুখালি ক্যাম্পের এক রোহিঙ্গা বলছেন, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্বে বেশ কয়েকবার ক্যাম্পে আগুন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর বাইরেও আগুন লাগার কিছু কারণ রয়েছে। সাধারণত এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য যে আগুন লাগানো হয় তার কারণ আমরা এখানকার বাসিন্দারা জানি। কিন্তু এর বাইরেও আগুন লাগানো হয় উদ্দেশ্যমূলকভাবে। সেগুলো কারা লাগায় তাদের আমরা চিনি না।
কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোহিঙ্গা আগুনের কারণ বিষয়ে আধিপত্য বিস্তারকেই চিহ্নিত করছেন। তার কথায়,‘আগুন লাগানোর বিষয়টি রাজনৈতিক। এখানে আরসা আরএসও আছে, রোহিঙ্গাদের নানা স্বার্থও আছে। এমন গ্রুপও আছে যারা আরওসার নামে চলে কিন্তু হয়তো কোনও যোগাযোগই তাদের মধ্যে নেই। আবার ত্রাণ নিশ্চিত করার জন্যও কখনও কখনও আগুন লাগে।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন মনে করেন এসব সুপারিশ দেওয়ার আগে আগুনের কারণগুলো চিহ্নিত করা এবং মূল উৎপাটন জরুরি। পাশাপাশি যেহেতু ক্যাম্পের সব রাস্তায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাওয়ার বাস্তবতা নেই সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহায়তা নিয়ে বিকল্প ছোট গাড়ি ও ভেতরে ফায়ার স্টেশন করার ব্যবস্থা করতে হবে। কাঁটাতার দিয়ে ক্যাম্পগুলো পৃথক করা সম্ভব না, এতে অধিকার লঙ্ঘন করার অভিযোগ উঠবে। ফলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কী করণীয় সেটি নির্ধারণ করতে হবে। সুত্র: বাংলাট্রিবিউন