আমার কাছে বাংলাদেশ সবচেয়ে এডভেঞ্চারাস জায়গা হল রোহিঙ্গা ক্যাম্প। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাদের বসবাস সেখানে, রোহিঙ্গারা দেখতে আমাদের মতনই, ভাষাও চাটগাঁইয়া ভাষার মতন, স্থানীয়রা তফাৎ ধরতে পারে, মানে বৃহত্তর চট্টগ্রামের অধিবাসীরা ওদের সাথে বাংলাদেশিদের তফাতটা ধরতে পারে কিন্তু আমরা যারা চট্টগ্রামের বাইরের তাদের পক্ষে এই তফাৎ ধরাটা কঠিন। রোহিঙ্গা ক্যাম্প বললেই হয়ত অনেকের চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক জরাজীর্ণ রিফিউজি ক্যাম্প, তাহলে সেই জায়গা আমার কাছে কেন বাংলাদেশের সবচেয়ে এডভেঞ্চারাস মনে হল? কারন আমার পৌনে দুবছরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা-
১. রোহিঙ্গারা মিয়ানমার কর্তৃক নির্যাতিত, কিন্তু কতটা যে নির্যাতিত তা ওদের জীবনের কাহিনী না শুনলে অনুভব করা যাবে না, একবার একটা বিষয় তদন্তে গিয়ে ২২/২৩ বছরের এক যুবকের কাছে তার লাইফের গল্প টানা ৪/৫ ঘন্টা ধরে শুনেছি। সে ভুয়া পাসপোর্ট বানিয়েছে, ইন্ডিয়া গিয়েছে, হায়দ্রাবাদে কারাভোগ করেছে, পরে আবার অবৈধ পন্থায় সৌদিও গিয়েছে, আরও কত কী!! তার মোবাইলের কললিস্ট আর মেসেঞ্জারের রেকর্ড দেখে নিজেকে চুনোপুঁটি মনে হচ্ছিল!! তার ব্যাপ্তি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে!!
২. রোহিঙ্গারা অনেক দেশেই অবৈধভাবে থাকলেও ইউএস এর লস এঞ্জেলস বা সুইজারল্যান্ড, জার্মানিসহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেই তারা সম্পূর্ণ বৈধভাবে আছে এবং নাগরিকত্ব লাভ করেছে।
৩. ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা না হলে জানতামই না যে কোন প্রকার পাসপোর্ট ছাড়াই সম্পূর্ণ বৈধ পন্থায় ইউএস, সুইজারল্যান্ড এর মতন দেশও ভিসিট করা যায়।
৪. রোহিঙ্গা মাত্রই মুসলিম নয়, সেখানে হিন্দু ক্যাম্প, খ্রিস্টান পাড়াও আছে। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে হাজার খানেক স্কুল, মাদ্রাসা ও মসজিদ আছে। সাথে মন্দির, চার্চও আছে।
৫. দেশি-বিদেশি প্রায় দেড়শ এনজিও ও জাতিসংঘের বেশ কিছু অরগানের হাজারের উপর কর্মকর্তা সেখানে কর্মরত। সেখানে জব রিলেটেড ইস্যু নিয়ে কত যে কাহিনী!!
৬. রোহিঙ্গা ক্যাম্প এর ভেতর কয়েক ডজন সো কল্ড সন্ত্রাসী গ্রুপ আছে, একেক গ্রুপ ক্যাম্পের একেক এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে ব্যস্ত, এর প্রেক্ষাপটে মাঝে মধ্যেই শুরু হত গোলাগুলি বা ব্যাপক সংঘর্ষ, যার প্রেক্ষাপটে মার্ডার, অপহরণ এর মামলাও কম হয়নি।
৭. ক্যাম্প ঘিরে কত রকম যে অবৈধ কারবার- মাদক, মানবপাচার, চোরাইপথে সোনা হতে শুরু করে সিগারেট!! ক্যাম্পের অভ্যন্তরে ডজনখানেক মার্কেটে হাজার খানেক দোকান আছে, এসব দোকান ভাড়া নিয়ে খুনাখুনির পর্যায়ও উপক্রম হয়। এসব দোকানে সোনা হতে শুরু করে লাখ টাকার শাড়ি পাঞ্জাবিও বিক্রি হয়!! এসবের সব যে অবৈধ তা কিন্তু নয়, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাঙালি আর রোহিঙ্গা মিলে একাকার!! অবৈধ অনেক কিছুই চাপা পড়ে যায় বৈধতার আড়ালে।
৮. ক্যাম্পের অভ্যন্তরে যারা থাকে তারা সবাই কী অনেক অসহায় বা গরীব? অধিকাংশই, তবে এদের মাঝে অনেকেই আছে যারা ওই দেশের কোটিপতিদের তালিকায় আছে, এমনকি সাবেক এমপি, চাকুরিচ্যুত মিয়ানমারের সরকারি কর্মকর্তা, আর্মির কর্মকর্তাও আছেন। এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা একবার আফসোস করে বলছিল, তার দুই ছেলে এখন অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা, অনেক পূর্বেই তারা সাগর পাড়ি দিয়ে সেখানে গিয়েছে, কিন্তু তিনি তার ছোট দুই মেয়ে নিয়ে এই খুপরি ঘরে বাস করে, নিরুপায় তারা, কোন দেশেরই যে নাগরিক না তারা, গেলে যেতে হবে অবৈধ পন্থায়, ধরা পড়লে কারাবাস, আর না পড়লেও রিস্ক, অবৈধ পন্থায় সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে তার নিজেরই আত্মীয়দের মধ্যে কয়েকজনার সলিলসমাধি হয়েছে। তার ছেলেদের ব্যাংক একাউন্টে কোটি টাকা কিন্তু দুপক্ষই নিরুপায়!
৯. ক্যাম্পের ভেতর অনেক বাসাতেই প্রস্টিটিউশন চলে, আছে ব্রোথেলও! অস্ট্রেলিয়ান এক নাগরিককেও আটক করেছিলাম সেখানে একবার, এদের ব্যাপ্তি কক্সবাজারের অনেক হোটেল মোটেল রিসোর্টেও ব্যাপ্ত।
এমন একটা জায়গার প্রায় প্রতিটি অলিগলি আমার মুখস্ত ছিল, লাইফের এক বড় অধ্যায় হয়ে থাকবে সেই সময়টা!! কিন্তু, একটা জিনিস না বললেই নয়, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে কী পরিমাণ মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে তা সেখানে কিছুদিন কাজের অভিজ্ঞতা না থাকলে জীবনেও অনুভব করতাম না, রিফিউজি বলতে যা বুঝায় তার বাইরেও সেখানে যে জগত এবং সেই জগতের বাসিন্দারা যে কতটা নির্যাতিত হলে নিজ দেশে তাদের কোটি কোটি টাকার সহায় সম্বল ছেড়ে এভাবে থাকে তা এই ফিল্ড এক্সপেরিয়েন্স না থাকলে বোঝা অসম্ভব!! আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আজ না হয় কাল এই স্বীকৃতি আমরা পাবই, এজন্য আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নোবেলবিজয়ী হবেনই হবেন, শুধু সময়ের অপেক্ষা!!!!
লেখক, নিহাদ আদনান তাইয়ান
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন)
গোপালগঞ্জ জেলা।
লিখাটি ফেইসবুক ফেইস থেকে নেওয়া