কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির বর্তমানে চারদিকে চেকপোস্ট থাকলেও তারা অবাধে ক্যাম্পের বাইরে আসা যাওয়া করলেও তল্লাশি করে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাই দিন দিন সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এমন কোন দিন নেই যে, রোহিঙ্গা শিবিরে দু’একটি সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটছে না।
আরো পড়ুন :: রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গুলি করে একই পরিবারের ৩ জনকে হত্যা
>>> উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিহত ১, গুলিবিদ্ধ এনজিও কর্মী
>>> রোহিঙ্গা সংকট একটি তাজা টাইম বোমা: ড. ইউনূস
ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার, মাদক চোরাচালান, অস্ত্র ব্যবসা, খুন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি অপরাধমূলক কর্মকান্ড যেন নিত্যনৈমতিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ধর-পাকড় অব্যাহত রাখলেও তা কোনমতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরসা ও আরএসও সহ দু’একটি সংগঠনের সদস্যাদের মধ্যে এ ঘটনা বেশি ঘটছে বলে স্থানীয় রোহিঙ্গাদের সূত্রে জানা গেছে।
তবে একাধিক সূত্র বলছে, ৫ আগস্টের পর থেকে ক্যাম্পে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নতুন করে সংঘটিত হওয়ার চেষ্টা করছে।
বিভিন্ন ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিতে আরসা প্রায় সময় আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। সংঘর্ষে দু’পক্ষই ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে গোলাগুলি করছে ক্যাম্পে।
এতে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দারাও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
সোমবার (২১ অক্টোবর) ভোরে উখিয়া ১৭ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে একই পরিবারের তিনজন নিহত হয়েছেন।
নিহতরা হলেন, উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ক্যাম্প-১৭ এক্স ব্লকের বাসিন্দা আহাম্মদ হোসেন (৬৫), তার ছেলে সৈয়দুল আমিন (২৮) ও মেয়ে আসমা বেগম (১৫)। উখিয়া থানার ওসি মো. আরিফ হোসইন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, ভোররাতে ঘরে ঢুকে একই পরিবারের তিনজনকে গুলি করে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। তাদের মরদেহ উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তবে কী কারণে হত্যা করা হয়েছে সেটি এখনও জানা যায়নি। ক্যাম্পের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
১৪ এপিবিএন অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মো. ইকবাল বলেন, ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ১৫-২০ জন সন্ত্রাসী ক্যাম্প-১৭ এক্স ব্লকে প্রবেশ করে আহমদ হোসেন ও তার পরিবারের সদস্যদের গুলি করে। এতে ঘটনাস্থলে আহাম্মদ হোসেন ও তার ছেলে সৈয়দুল আমিন নিহত হয়। আহত অবস্থায় আহমদ হোসেনের মেয়ে আসমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় মারা যান তিনি।
তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, নিহত রোহিঙ্গা সৈয়দুল আমিন আরসার সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সম্পৃক্ত থাকার কারণে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা তাদের হত্যা করে। ঘটনার পর সন্ত্রাসীরা লাল পাহাড়ের এস-৪, বি-৭ ব্লক দিয়ে পালিয়ে যায়।
এদিকে, বুধবার (২ অক্টোবর) বেলা পৌনে ৪টার দিকে উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের হাকিম পাড়া ১৪ নম্বর এবং জামতলী ১৫ নম্বর ক্যাম্পের মাঝামাঝি এলাকায় ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরসা ও আরএসও- এর মধ্যে গোলাগুলিতে আব্দুর রহমান (১৯) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। এতে আহত হয়েছেন অন্তত পাঁচজন। ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (এডিআইজি) মো. আমির জাফর ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
নিহত আব্দুর রহমান উখিয়া উপজেলার হাকিম পাড়া ১৪ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ই-২ ব্লকের মোহাম্মদ আব্দুল্লাহর ছেলে। আহতরা হলেন, উখিয়ার হাকিম পাড়া ১৪ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ই-২ ব্লকের সিদ্দিক আহমেদের ছেলে নুর মোহাম্মদ, সুলতান আহমেদের ছেলে মোহাম্মদ জোবায়ের, রশিদ উল্লাহর ছেলে মো. শাফায়েত, দিল মোহাম্মদের ছেলে নুর আলম এবং জামতলী ১৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের লাল মিয়ার স্ত্রী নেসারা।
স্থানীয়দের বরাতে এপিবিএন অধিনায়ক বলেন, ওইদিন বিকেলে উখিয়ার হাকিম পাড়া ১৪ নম্বর এবং জামতলী ১৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝামাঝি এলাকায় মিয়ানমারের সন্ত্রাসী সংগঠন আরসা এবং আরএসও এর সন্ত্রাসীরা অতর্কিত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এসময় উভয়পক্ষ ২০/২৫টি গুলি ছুড়ে। এতে ছয়জন রোহিঙ্গা গুলিবিদ্ধ হন।
খবর পেয়ে এপিবিএন পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছালে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। তিনি জানান, স্থানীয়রা আহতদের উদ্ধার করে জামতলীতে এমএসএফ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক একজনকে (আব্দুর রহমান) মৃত ঘোষণা করেন। পরে আহত অন্যদের উন্নত চিকিৎসার জন্য কুতুপালংয়ের এমএসএফ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
অপরদিকে, বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) দিনভর উখিয়ার ১৪ ও ১৫নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুই পক্ষের সংঘর্ষে এক বাংলাদেশিসহ পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এ ছাড়া এঘটনায় আরও পাঁচজন আহত হয়েছেন।
গুলিবিদ্ধরা হলেন- উখিয়ার পালংখালীর মোহাম্মদ বেলাল (৩৯), উখিয়ার জামতলী ১৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-৭ ব্লকের বাসিন্দা হোসেনের ছেলে ওমর ফারুক (৩০), একই ক্যাম্পের বি-৩ ব্লকের বাসিন্দা আব্দুর রশিদের ছেলে মো. ইউনুস (২৫), উখিয়ার ১১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সি-২ ব্লকের বাসিন্দা মো. আলসের ছেলে আবদুল্লাহ (১৮) ও একই ক্যাম্পের আবদুল গনির মেয়ে হামিদা (৫০)।
৮ এপিবিএনের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) আমির জাফর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হয়। বর্তমানে তারা উখিয়ার কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। তবে কে বা কাদের মধ্যে এই সংঘর্ষের ঘটনা তা জানা যায়নি।
অন্যদিকে, রোববার (২০ অক্টোবর) ভোরে উখিয়া উপজেলার ১৫নং রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে অস্ত্র ও অ্যামোনেশনসহ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (৮-এপিবিএন)-এর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে হোসাইন জোহর (৩২) নামে আরসার গান গ্রুপ কমান্ডার। গ্রেপ্তার আরসার গান গ্রুপ কমান্ডার মো. হোসাইন জোহর থাইংখালী ১৫নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এইচ/৭ ব্লকের বাসিন্দা মৃত মো. দলুমিয়ার ছেলে।
৮-এপিবিএনের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মো. আমির জাফর জানান, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে মো. হোসাইন জোহরকে তার নিজ বাসা থেকে একটি ওয়ান শুটার গান, দুই রাউন্ড অ্যামোনেশন এবং চার রাউন্ড খালি খোসাসহ গ্রেপ্তার করা হয়।
তিনি আরও জানান, সে মিয়ানমারের নাগরিক এবং সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার গান গ্রুপ কমান্ডার হিসেবে বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কিলিং মিশনে অংশগ্রহণ করত। সে আরএসও কমান্ডার খায়রুল আমিন হত্যার এজাহারভুক্ত আসামি।
এছাড়া, বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) রাতে উখিয়া পালংখালী ক্যাম্প-১৩ থেকে একটি জি থ্রি রাইফেল ও ১০টি গুলিসহ নুরুল ইসলাম (৪৫) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) কমান্ডার ছিলেন বলে জানিয়েছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। গ্রেপ্তার নুরুল ১৩ নম্বর ক্যাম্পের গুলা হোসেনের ছেলে।
তিনি দীর্ঘদিন ধরে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) কমান্ডার হিসাবে ক্যাম্পে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেন, ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক ও অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আমির জাফর।
তিনি জানান, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের গোয়েন্দা শাখা সূত্রে ১৩ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অস্ত্র আসছে এমন গোপন খবর পাওয়া যায়। এ তথ্যের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার ভোরে ক্যাম্পে বিশেষ অভিযান চালিয়ে নুরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে একটি জি থ্রি রাইফেল ও ১০টি গুলি উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে, নুরুল ইসলাম আরসার কমান্ডার হিসেবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।
এদিকে স্থানীয় পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন জানান, ক্যাম্পে গোলাগুলিসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনা নিত্যদিনের। রোহিঙ্গারা গ্রেফতার হয় তবে তারা আইনের ফাঁকে বের হয়ে যায়। যার কারণে অপরাধ দমন অনেকটা কঠিন হয়ে পড়েছে। তারা যেন জেল থেকে ছাড়া না পায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই কিছুটা অপরাধ রোধ হতে পারে।
উখিয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মোহাম্মদ আরিফ হোসাইন জানান, প্রতিদিনই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কঠোর পরিশ্রম করছে রোহিঙ্গা শিবিরে। অনেক অপরাধী এখনও জেলে আছে। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি রোহিঙ্গা শিবিরে যেন অপরাধ সংঘটন বন্ধ হয়ে যায়।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর হোসেন জানান, রোহিঙ্গারা যেন সীমানা প্রাচীর বেধ করে বের হতে না পারে আমরা প্রশাসনকে সেদিকে ত্রীক্ষè নজর রাখতে বলেছি। এছাড়া বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিদিনই রোহিঙ্গা শিবিরে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।