কক্সবাজারের আশ্রয় শিবিরগুলোতে বাড়ছে অস্থিরতা। কোনোভাবেই থামছে না খুনের ঘটনা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দারা বলছেন আধিপত্য বিস্তারের জেরে এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, ক্যাম্পে বেশকিছু গ্রুপ মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ নানা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করছে। আর এসবের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আধিপত্য বিস্তারের জেরে বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।
এরই জের ধরে মঙ্গলবার (২১ মার্চ) দিন-দুপুরে ক্যাম্পে ফের দুষ্কৃতিকারীদের গুলিতে মারা গেছেন দুই রোহিঙ্গা। গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন আরও এক রোহিঙ্গা।
এদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কথিত সন্ত্রাসীদের গুলিতে সম্প্রতি প্রাণ হারিয়েছেন আরও আট রোহিঙ্গা।
মঙ্গলবারের ঘটনার বিষয়ে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী জানান, মঙ্গলবার দুপুর ১টার দিকে উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের বালুখালী ১৩ নম্বর আশ্রয় শিবিরে গুলিতে দুইজন রোহিঙ্গা মারা গেছে। নিহতরা হলো- উখিয়ার বালুখালী ১৩ নম্বর আশ্রয় শিবিরের জি-৪ ব্লকের বাসিন্দা বাঁচা মিয়ার ছেলে মো. রফিক (৩০) এবং একই এলাকার মোহাম্মদ হাসানের ছেলে মোহাম্মদ রফিক (৩৪)।
ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আশঙ্কাকজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন একই এলাকার মোহাম্মদ হোসাইনের ছেলে মোহাম্মদ ইয়াছিন (২৮)।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে ওসি মোহাম্মদ আলী জানান, মঙ্গলবার দুপুরে উখিয়ার বালুখালী ১৩ নম্বর আশ্রয় শিবিরে জি-৪ ব্লকে বাঁচা মিয়ার ছেলে মো. রফিক ঘরে অবস্থান করছিলেন। এক পর্যায়ে ১৫ থেকে ২০ জনের মুখোশধারী দুষ্কৃতিকারী ঘরে প্রবেশ করে তাকে লক্ষ্য করে কয়েকটি গুলি চালায়। এতে তিনি ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। এ সময় দুষ্কৃতিকারীদের চালানো গুলিতে আরও দুই জন গুলিবিদ্ধ হন। পরে খবর পেয়ে এপিবিএন পুলিশ ও উখিয়া থানা পুলিশের দুটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছালে দুষ্কৃতিকারীরা পালিয়ে যায়। এ সময় একজনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। পরে ঘটনাস্থল থেকে গুলিবিদ্ধ দুই জনকে স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে এলে চিকিৎসক মো. রফিক নামের আরও একজনকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত অপর একজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন গুলিবিদ্ধ মোহাম্মদ ইয়াছিন। তিনি বলেন, একদল মুখোশধারী হঠাৎ এসে গুলি করা শুরু করে। এতে ঘটনাস্থলে চিৎকার শুরু হয়ে যায়। আমি ঘরের ভেতরে ছিলাম, চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই মুখোশধারীরা ঘরে ঢুকে গুলি করে চলে যায়।
ঘটনায় জড়িতদের ধরতে পুলিশ তৎপর রয়েছে দাবি করে ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ খুনের ঘটনা ঘটেছে। তবে কারা, কী কারণে ঘটনা ঘটিয়েছে পুলিশ এখনও নিশ্চিত নয়। ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেফতারে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে।’
নিহতদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে ঘটনার পেছনে পূর্ব শত্রুতার জের রয়েছে ধারণা করছেন ৮ এপিবিএন এর সহকারী পুলিশ সুপার (অপস্ অ্যান্ড মিডিয়া) মো. ফারুক আহমেদ।
তিনি বলেন, পূর্ব শত্রুতার জের ধরে এ হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। ক্যাম্পের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারি ও অপরাধীদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। ইতোমধ্যে ৮ এপিবিএন এর কমান্ডিং অফিসার মো. আমির জাফরসহ অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে অপরাধীদের গ্রেফতার করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পরিকল্পিত আগুন
এদিকে গত রোববার (০৫ মার্চ) বিকেল ৩টার দিকে বালুখালীর ১১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। টানা তিন ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হলেও পুড়ে যায় দুই হাজার ঘর। ক্ষতিগ্রস্ত হন ১২ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা।
এ ঘটনাকে ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নাশকতা’ বলে অভিহিত করেছে তদন্ত কমিটি।
জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্যমতে, ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দুই হাজারের বেশি ঘর (শেল্টার) পুড়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ হাজারের বেশি। ক্যাম্প-১১ আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা থাকেন ৩২ হাজার ২০০। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৯০টির বেশি বেসরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, লার্নিং সেন্টার, ত্রাণকেন্দ্রসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে।
তবে ক্যাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটির জন্য কথিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে দায়ী করছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। তারা জানান, কথিত সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। শুধু এক স্থানে না, একযোগে অন্তত পাঁচটি জায়গায় আগুন ধরিয়ে দেয় সন্ত্রাসীরা।
কেন খুন হচ্ছেন রোহিঙ্গা নেতারা
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, দুটি কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কমিউনিটি নেতাদের খুন করছে কথিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো। এক হচ্ছে, কথিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর ব্যাপারে কেউ তথ্য দিলে তা তারা জেনে যায়। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে তথ্যদাতাকে ধরে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে। কারণ ক্যাম্পে তাদের অসংখ্য নেটওয়ার্ক রয়েছে।
দ্বিতীয় হচ্ছে, আগে অনেক কমিউনিটি নেতা কথিত সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে সহযোগিতা করতো। কিন্তু এখন না করাতে তারা ‘মুনাফিক’ হয়ে গেছে বলে টার্গেট করে হত্যা করছে।
আতঙ্কে স্থানীয়রা
এদিকে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের খুনের ঘটনা বাড়ায় আতঙ্কে রয়েছেন স্থানীয়রা। এসব ঘটনার পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে দাবি জনপ্রতিনিধিদের।
হলদিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, ‘ক্যাম্পকে ঘিরে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বাংলাদেশকে যারা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়, তারা রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে এসব ঘটনাগুলো করাচ্ছে।’
সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে জঙ্গি সদস্য গ্রেফতারের বিষয়টি উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, , ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে শীর্ষ জঙ্গি সংগঠনের দু’জন প্রধান নেতা গ্রেফতার হয়েছেন। বিষয়টি আমাদের এই অঞ্চলের জন্য খুবই উদ্বেগের। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিলাম রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নজরদারি বাড়ানোর জন্য এবং সেখানে যৌথ অভিযান চালানোর জন্য। যে জঙ্গিরা ধরা পড়েছে তাদের নিশ্চয়ই ডালপালা এই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আছে, তাদের অনুসারী আছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।’
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধ নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন সংশ্লিষ্টরাও। অবশ্য সবাই মিলে কাজ করলে অপরাধ দমন সম্ভব বলে মত তাদের।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে আমরা অবশ্যই চিন্তিত। তবে ক্যাম্পে তিনটি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) রয়েছে। সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছে ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজি। তারা প্রতিনিয়ত কাজ করছেন। আমরা তাদের সঙ্গে সমন্বয় করছি। এ ছাড়া বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ করছে। তারপরও কিছু ঘটনা ঘটছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বে থাকা ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মো. আমির জাফর বলেন, ক্যাম্পে বেশকিছু গ্রুপ কাজ করে। যাদের কাজ হচ্ছে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ নানা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ। আর এসব নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে আধিপত্য বিস্তার একটা বিষয় থাকে। এরা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে হত্যা-অপহরণসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে।
মো. আমির জাফর আরও বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করছি। কখনো এপিবিএন পুলিশ একা করছে, কখনো জেলা পুলিশ বা র্যাবকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছে। তবে সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় আশা করি, ক্যাম্পের এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জঙ্গিদের উপস্থিতি এবং অপরাধ বিষয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করে যাচ্ছি। এখানে যে শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর র্যাব ফোর্সেস, এপিবিএন, পুলিশ শুধু তাই নয়, সরকারি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাও আছে; আমরা সবাই সমন্বিতভাবে একত্রে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কাজ করছি। অবশ্যই আমাদের নজরদারি ছিল বলেই বিভিন্ন সময় অভিযানগুলো করতে পারছি এবং নতুন যে জঙ্গি সংগঠনের সামরিক শাখার প্রধান, তাকে আমরা এখান থেকেই গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি।’
ক্যাম্প ঘিরে নজরদারি চলবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নজরদারি অব্যাহত রয়েছে এবং ভবিষ্যতে অবশ্যই নজরদারি আরও জোরদার করা হবে।’ সুত্র: সময় টিভি
পাঠকের মতামত