কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়ানক সব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেই চলেছে। এতে দিন দিন বেড়েই চলছে প্রাণহানি, ঘর ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি। গত সাত বছরে বড়-ছোট মিলে অন্তত ২২৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। কিছু অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত রান্নাঘরের গ্যাস সিলিন্ডার থেকে ঘটেছে বলে প্রচার পেলেও কিছু কিছু অগ্নিকাণ্ডের সূত্র অজানাই থেকে গেছে। তাই এসব অগ্নিকাণ্ড রহস্যঘেরা বলেই মনে করছেন সাধারণ রোহিঙ্গারা।
সূত্র মতে, সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২০২১ সালের ২২ মার্চ উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে। আগুনে বালুখালীর পাঁচটি ক্যাম্পে ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বসতি পুড়ে ছাই হয়। তখন ছয় শিশুসহ অন্তত ১৪ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছিল। গৃহহীন হয় ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর কয়েক মাসে। এর আগে নানা সময়ে এসেছে প্রায় তিন লাখ। আর গত সাত বছরে শিশু জন্ম নিয়েছে প্রায় দেড় লাখ।
২০১৭ সালের পর হতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে উদ্যোগ চললেও একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। বরং সাম্প্রতিক সংঘাতের ফাঁকে ফাঁকে বহু রোহিঙ্গা দুই উপজেলার বিভিন্ন ক্যাম্পে অনুপ্রবেশ করেছে। এদের সংখ্যাও প্রায় লাখ খানেক বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
এদিকে, বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) সকালে উখিয়ার ১৮ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বি-ব্লকের, বি-৫২ সাব ব্লকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪টি শেল্টার ও একটি দোকান ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এ ঘটনায় কোনো হতাহতে খবর মিলেনি।
দুর্ভোগের শিকার রোহিঙ্গারা জানান, বি-ব্লকের, বি-৫২ সাব ব্লকের বাসিন্দা রশিদের ঝুপড়ি ঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুন দেখতে পেয়ে স্থানীয়রা এগিয়ে এসে দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করে। পরে ক্যাম্পের ফায়ার সার্ভিসের স্বেচ্ছাসেবকরা এসে আগুন নিয়ন্ত্রণ করেন। ততক্ষণে চারটি বসত ঘর ও একটি দোকান পুড়ে ছাই যায়।
রশিদের অভিযোগ, তার দোকান ও বসত ঘরে দুর্বৃত্তরা আগুন দিয়ে পালিয়েছে। স্থানীয়রা সহযোগিতা করে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও ততক্ষণে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
ক্ষতিগ্রস্ত বিলকিছ বেগম জানান, দুর্বৃত্তরা আগুন দিয়ে পালিয়ে যেতে দেখেছে অনেকে। স্বামী বাড়িতে ছিলনা, তাই কিছুই বের করা সম্ভব হয়নি। ক্যাম্পের স্বেচ্ছাসেবকরা এসে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে।
উখিয়া ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, আগুনের খবর পেয়ে দমকল বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই ক্যাম্পের স্বেচ্ছাসেবকরা আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। এতে একটি দোকান ও ৪টি বসত পুড়ে যায়। স্বেচ্ছাসেবক ও শিবিরের বাসিন্দারা সচেতন থাকার কারণে বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছে।
এর আগে বুধবার (২২ জানুয়ারি) উখিয়ার ক্যাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সবকিছু হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর দিন কেটেছে কয়েক হাজার রোহিঙ্গার। অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয় রোহিঙ্গাদের ৬০০ এর বেশি বসতি, মারা যায় শিশুসহ দুইজন। একে তো শীত, তার ওপর বসতি হারিয়ে চরম কষ্টে পড়ে এসব রোহিঙ্গারা।
ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা বসতির বহু পরিবারে কাপড়-চোপড়, আসবাবপত্র কিংবা খাদ্যসামগ্রী কিছুই নেই। শুধু কোনো রকম পরিবার-পরিজন নিয়ে নিরাপদ আশ্রয় গিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন তারা। অনেক রোহিঙ্গা পুড়ে ছাই হওয়া বসতিতে ফিরে খুঁজে বেড়ান কিছু পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু আগুন তাদের সব সম্বল কেড়ে নেয়। শীতের মাঝে বসতি হারিয়ে খোলা আকাশে দিন কাটায় সেসব রোহিঙ্গা পরিবারগুলো।
শুধু বসতি নয়, টয়লেট গোসলখানা পুড়ে গিয়ে পয়ঃনিষ্কাশন গোসলসহ সবকিছু নিয়েও ভুগছে অনেকে।
তবে, ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের অনেকেই ধ্বংসস্তূপের ওপর ত্রিপল বা বাঁশ দিয়ে কোনোমতে মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করছেন। অগ্নিকাণ্ডে সবকিছু পুড়ে যাওয়ায় অনেকে অভুক্ত।
ক্ষতিগ্রস্ত কুলছুমা বলেন, আগুন আমার চোখের সামনে সব কিছু পুড়িয়ে ফেলে, কিন্তু করার কিছু ছিল না।
গৃহহীন আরেক রোহিঙ্গা ছৈয়দ আকবর বলেন, প্রতিবছর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ড রাতে ঘটলেও এবার দিনে-দুপুরে ঘটনা ঘটেছে। ক্ষতিগ্রস্ত সবার খুবই কষ্টে দিন কাটছে।
তবে অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডকে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতারা। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, নানা ধরণের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। শুধুমাত্র রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন থেমে থাকতেই এসব অগ্নিকাণ্ড ঘটানো হয় বলে আমাদের ধারণা।
তার মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছোট বড় সাতটির অধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের অতিরিক্ত কমিশনার সামছুদ্দৌজা নয়ন বলেন, অগ্নিকাণ্ড অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্যোগ। গত সাত বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছোট-বড় সোয়া ২০০ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি দুই ঘণ্টার অগ্নিকাণ্ডে ক্যাম্পের ডি ও সি ব্লকের ৬১৯টি রোহিঙ্গা বসতি পুড়ে গেছে। তাতে ৩ হাজার ২০০ রোহিঙ্গা ক্ষতিগ্রস্ত হন। আগুনে পুড়ে মারা যান দুজন। গৃহহীনদের জন্য দুপুর ও রাতে রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হয়। অধিকাংশ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা স্বজনের ঘরে অবস্থান নেয়। ধ্বংসস্তূপের ওপর স্থায়ী ঘর নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে। নকশার কাজ শেষ হয়েছে, নির্মাণ কাজ শুরু হবে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত ১৪ এপিবিএন অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) সিরাজ আমিন জানান, ক্যাম্পে প্রায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে তদন্ত চলছে। কেউ ইন্ট্যানশনালি আগুন লাগানোর ঘটনা প্রমাণ হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে। জাগো নিউজ
পাঠকের মতামত