মিয়ানমারের রাখাইনে থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মানবতার কথা চিন্তা করে কক্সবাজারের সীমান্তঞ্চল টেকনাফ আর উখিয়ায় আশ্রয় দিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু মাত্র পাঁচ বছরেই পাল্টে গেছে দেশের নিসর্গ সুন্দর এই সীমান্ত জনপদের দৃশ্যপট। রোহিঙ্গা ক্যাম্প এখন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ মাদকের পাইকারি বাজার।
খুন, গুম নিত্য দিনকার ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অপহরণকারীদের আস্তানা ক্যাম্পগুলো এখন স্থানীয়দের আতঙ্ক। ইতোমধ্যে সমূলে বিনষ্ট হয়েছে কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পাহারঘেরা নয়নাভিরাম পরিবেশ বৈচিত্র্য।
এখন নষ্ট হচ্ছে সামাজিক সম্প্রীতি। স্থানীয় বাংলাদেশি নাগরিকদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সহিংস আচরণই যেন সেখানে ভবিতব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের প্রতি সবার আগে হাত বাড়ানো স্থানীয়রাই এখন কোণঠাসা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানবতার খাতিরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে, সেই রোহিঙ্গারা এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশে।
গত কয়েক দিন কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবির ঘুরে বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে এমন সব আশঙ্কাজনক তথ্য পাওয়া গেছে। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ নিবন্ধিত রোহিঙ্গা আছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে ৮ লাখ রোহিঙ্গা এসে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। সেটা যেন ‘ওপেন সিক্রেট’। কিন্তু কেউ এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো কথা বলতে চান না। কারণ তাদের ভয়, কেউ ‘ফোকাস’ হয়ে গেলেই তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। কারণ, যারাই এসব বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেছে, এমনকি প্রশাসন- গোয়েন্দাকে তথ্য দিয়েছে বলে সন্দেহ হয়েছে, তারাই পরবর্তীতে এসব গোষ্ঠীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।
অপরাধের ঘাঁটি : কক্সবাজারের ৩৪ রোহিঙ্গা শিবির এখন অপরাধের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। গত সাড়ে পাঁচ বছরে প্রায় দেড় শতাধিক খুন সংঘটিত হয়েছে। মামলা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার। হুমকিতে রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপত্তা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই শরণার্থী শিবিরে সংঘাত, ডাকাতি, ধর্ষণ, অপহরণ, খুন যেন স্বাভাবিক চিত্র। কক্সবাজারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে ২০১৭ সালে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের একটা অংশ ২০১৮ সালের শুরু থেকে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে।
এরপর থেকে গত সাড়ে পাঁচ বছরের অধিক সময়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একে একে খুনের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া মাদক, অস্ত্র, ছিনতাই, ডাকাতি, ধর্ষণ, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘাত, অপহরণ, হত্যাচেষ্টা, চাঁদাবাজি, মানব পাচার, সোনা চোরাচালানসহ ১৪ ধরনের অপরাধে তারা জড়িত। খুনের শিকার হওয়া রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন ব্লকের মাঝি ও জিম্মাদার। এ ছাড়া ২০১৮ সালে দেশব্যাপী চালানো মাদকবিরোধী অভিযানে কক্সবাজারে বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ২৭৯ জন। এর মধ্যে রোহিঙ্গা ১০৯ জন।
অস্ত্রের ঝনঝনানি : রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শুরুর দিকে দেশীয় অস্ত্র যেমন ছুরি, চাকু, রামদা দিয়ে কিছু অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। সেই ক্যাম্পে এখন নানা ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের ঝনঝনানি। ঘরে ঘরে এখন অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। সশস্ত্র রোহিঙ্গা দলগুলো দেশ-বিদেশের আধুনিক অস্ত্রের মজুদ বাড়াচ্ছে। আর এ কাজে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধেও। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৩০ মাফিয়া রয়েছে, যারা নিয়ন্ত্রণ করছে আশ্রয়শিবিরের অপরাধ জগৎ। সরেজমিনে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কক্সবাজার জেলার টেকনাফ ও উখিয়ায় ছোট-বড় কোনো পাহাড়ে স্থানীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ নেই। সবুজ পাহাড়ে ছাউনি দেওয়া ঘরে অস্ত্র সামনে রেখে আড্ডা দেয় সশস্ত্র রোহিঙ্গারা। পাশেই দুই হাতে পিস্তল চালানোর প্রশিক্ষণ নেয় উঠতি বয়সী রোহিঙ্গারা। কখনো পাহাড়ের সীমানা দখল নিয়ে চলে বিবাদ-বিসম্বাদ।
১০ ভয়ংকর গ্রুপ : সরকারি সংস্থাগুলো বলছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ১০টি ভয়ংকর দুর্বৃত্ত দল বর্তমানে সক্রিয় রয়েছে। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসাসহ তিনটি সন্ত্রাসী গ্রুপ এবং সাতটি ডাকাত দল রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ ক্যাম্পের ওপর রয়েছে আরসার নিয়ন্ত্রণ। জিরো লাইনে অবস্থিত তুমব্রু কোনাপাড়া ক্যাম্পটিতে নিয়মিত টহল ও নজরদারি জোরদার করা যায়নি। এ কারণে কোনাপাড়া ক্যাম্পটি আরসার সাংগঠনিক কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ, মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে।
বনাঞ্চল ধ্বংস : কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের প্রায় ১২ হাজার একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে গত সাড়ে পাঁচ বছরে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে ধ্বংস হয় এই বনভূমি। বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী এশিয়ান প্রজাতির হাতির অন্যতম আবাসস্থল ছিল উখিয়া-টেকনাফের এই বনভূমি। আর এতে হুমকির মুখে পড়েছে বন্যহাতি। তাই প্রতি বছর লোকালয়ে হানা দিচ্ছে বন্যহাতি। এতে হাতি যেমন মারা পড়ছে তেমনি মানুষসহ গবাদিপশুর মৃত্যু ঘটছে আশঙ্কাজনক হারে।
উখিয়া কুতুপালং মহাসড়কের পাশে টাঙানো রয়েছে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড- ‘বন্যহাতি চলাচলের পথ’। এর ঠিক পেছনেই ছোট-বড় গাছপালা কেটে নির্মাণ করা হয়েছে শরণার্থী ক্যাম্প। উঁচু পাহাড়ের কোল কিংবা পাদদেশ পাহাড় কেটে থরে থরে নির্মাণ করা হয়েছে ২ লাখের বেশি অস্থায়ী ঘর। স্থাপন করা হয়েছে নলকূপ, টয়লেট, বিদ্যুৎ লাইন, সড়ক, নিষ্কাশন খাল, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার কার্যালয়সহ গুদাম ঘর। জ্বালানির জন্য উজাড় হচ্ছে বন। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বন্যহাতির চলাচল ও বিচরণ ক্ষেত্র। এখন আর দেখে বোঝার উপায় নেই- এসব পাহাড়ে পাঁচ বছর আগেও ছিল সবুজ অরণ্য এবং হাতির রাজত্ব।
বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের জন্য এ অঞ্চলের প্রায় ১২ হাজার ২০০ একর বনভূমি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। পাশাপাশি আরও ৩ থেকে ৪ হাজার একর বনভূমির গাছপালা উজাড় হয়েছে রোহিঙ্গাদের জ্বালানি সংগ্রহের জন্য।
কক্সবাজার ও টেকনাফের বিশাল পাহাড়ি বনভূমিতে ৫২৫ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া যেত, যা স্তন্যপায়ী বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। কিন্তু পাহাড়ে রোহিঙ্গা বসতির কারণে এসব এখন ধ্বংসের পথে। রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় জনগোষ্ঠী বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনই হচ্ছে এসব সমস্যার একমাত্র সমাধান।
রোহিঙ্গারা দিনের পর দিন যেভাবে অপরাধ করে বেড়াচ্ছে তার ফলে স্থানীয়দের নিজ এলাকায় বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়ছে। স্থানীরা বলছেন, রোহিঙ্গারা এখন তাদের কাছে এক আতঙ্কের নাম। তাদের একটিই দাবি, রোহিঙ্গাদের দ্রুত মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হোক। প্রত্যাবাসন যত বিলম্বিত হচ্ছে, সমস্যা ততই বাড়ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা প্রথমে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল।
কিন্তু তাদের অবস্থান দীর্ঘয়িত হওয়ার কারণে এবং রোহিঙ্গাদের সহিংস আচরণ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কারণে সেই সময়ের সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অবস্থানের কারণে স্থানীয়রা বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। যার মধ্যে পণ্যের অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি প্রধান। এরপর আছে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি কমে যাওয়া।
রোহিঙ্গাদের আগমনের কারণে স্থানীয়দের দৈনন্দিন এবং সামাজিক জীবনযাত্রার ও ব্যাঘাত ঘটছে। তাদের কারণে স্থানীয়রা ফসলি জমি, শ্রমবাজার সবকিছু হারিয়েছে। দ্রুত প্রত্যাবাসন না হলে বর্তমানে যেভাবে মাদক ও অস্ত্র পাচার বৃদ্ধি পেয়েছে তা যদি আরও বাড়তে থাকে তাহলে স্থানীয়দের জন্য বিশাল হুমকি হয়ে দাঁড়াবে এই রোহিঙ্গারা। কর্তৃপক্ষ এসব সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে এবং তার অবনতি যাতে না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখছে।
কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গারা ২০১৭ সালে আসার পর থেকে যেসব অপরাধে জড়িত ছিল এখনো সেই ধরনের অপরাধ করছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের গ্রুপ রয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মারামারি, সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। এমনকি খুন, মাদক, চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে অনেক রোহিঙ্গা। এ ধরনের কর্মকান্ডের কারণে তারা নিজেদের জন্যই ঝুঁকি তৈরি করছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন এনজিওর তত্ত্বাবধানে ক্যাম্পে সাধারণ রোহিঙ্গারা নিরাপদে আছে।