ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ১৩/০৩/২০২৫ ৪:৩৩ এএম

কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় অবস্থিত ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্যের লড়াই যেন ‘স্থায়ী সংস্কৃতিতে’ পরিণত হয়েছে। অস্ত্র ও মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই মূলত এ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি, যা এখনো অব্যাহত। গত ৪ বছরের বিভিন্ন সময়ে আটটি গ্রুপের মধ্যে সংঘটিত এসব ঘটনায় অন্তত ২০২ জন খুন হয়েছেন। আহত হয়েছেন অসংখ্য। এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে খাদ্য সহায়তা কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেওয়া হয়। এটি কার্যকর হবে ১ এপ্রিল থেকে। এতে ক্যাম্পগুলোয় খাদ্যসংকট চরম আকার ধারণ করতে পারে-এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, বিদ্যমান সমস্যার সঙ্গে নতুন করে খাবার সংকট যোগ হলে গোটা পরিস্থিতির অবনতি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। এ ধরনের অবস্থা মোকাবিলা করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য হবে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং।

যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধান ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে আরও জানা গেছে, এসব ক্যাম্পে আগ্নেয়াস্ত্র আসছে মিয়ানমার থেকে। পাশাপাশি অস্ত্র তৈরি হচ্ছে কক্সবাজারের মহেশখালীসহ বিভিন্ন স্থানেও। এসব অস্ত্রই কাজ করছে আধিপত্য লড়াইয়ের মূল চালিকাশক্তি হিসাবে। গ্রুপগুলো হলো-আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি), আরএসও (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন), আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি (এআরএ), নবী হোসেন গ্রুপ (গ্রুপপ্রধান নিহত), মাস্টার মুন্না গ্রুপ, দীল মোহাম্মদ ওরফে মার্স গ্রুপ, ডাকাত সালমান গ্রুপ ও ডাকাত সাদ্দাম গ্রুপ। এসব গ্রুপের তৎপরতায় ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ২০২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কেবল আরসা, আরএসও এবং এআরএ-এর মধ্যে গ্রুপিংয়ের কারণেই ৬৭ ভাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর প্রতিমাসেই গড়ে একটি করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। গত সাত মাসে ঘটেছে আটটি। সবশেষ ৮ মার্চ উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন নিহত হন। ওইদিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে উখিয়া উপজেলার বালুখালী ৮-ইস্ট নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সশস্ত্র সংগঠন আরসা ও আরএসও সদস্যরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে ওই রোহিঙ্গা যুবক মোহাম্মদ রফিক (৩৩) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

Advertisement

সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, ক্যাম্পগুলোয় চলছে জমজমাট অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা। মানব পাচারের ঘটনাও আছে। গত সাত মাসে ১৬টি অস্ত্র মামলায় ২৩ জনকে গ্রেফতার করেছেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সদস্যরা। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের মধ্যে ছিল ওয়ান শুটারগান ২৪টি। একই সময়ে ৩১টি মাদক মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ৩৫ জনকে। উদ্ধার করা হয়েছে আইস-ক্রিস্টাল মেথ, ইয়াবাসহ বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য। এর মধ্যে ইয়াবার সংখ্যাই ৭০ হাজার পিস।

জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ১ এপ্রিল থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। খাদ্য সংকট দেখা দিলে স্বভাবিকভাবেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। সেটা মোকাবিলা করা অনেক চ্যালেঞ্জিং হবে। তিনি জানান, বর্তমানে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে রেজিস্ট্রেশনকৃত রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতিমাসে ১২ দশমিক ৫ ডলার সহায়তা দেওয়া হয়। কিন্তু ১ এপ্রিল থেকে দেবে ছয় ডলার করে। এখন রোহিঙ্গারা যে খাবার পায়, তা প্রতিবেলা ১৬ টাকা করে। আর সেটা যদি আট টাকারও কম হয়, পরিস্থিতি কী হতে পারে, তা স্বভাবিকভাবেই অনুমান করা যায়।

কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেশি। তাদের যুগের পর যুগ হত্যা-নির্যাতনের মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে। ক্যাম্পগুলোয় অসংখ্য যুবক আছে, যারা নিজ চোখে তার মা-বোনকে ধর্ষিত হতে, বাবাকে হত্যা করতে দেখেছেন-এ ধরণের জনগোষ্ঠীকে পাহারা দিয়ে রাখা নিঃসন্দেহেই জটিল একটি বিষয়। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের একটি অংশ বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গেছে। ইয়াবা চোরাচালন এবং অবৈধ অস্ত্রই রোহিঙ্গাদের অন্তর্দ্বন্দ্বের মূল কারণ। যেহেতু ক্যাম্প থেকে পাঁচ কিলোমিটার ওপারেই যুদ্ধ হচ্ছে, তাই সহজেই অনুমেয় অস্ত্র কোথা থেকে আসছে। এছাড়া বাংলাদেশ থেকেই অস্ত্র সংগ্রহ করছে। মহেশখালীসহ কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানেও আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশি দুষ্টচক্র ও চোরাচালানিদের সঙ্গে রোহিঙ্গা অপরাধীদের একটি সংযোগ আছে।

অতিরিক্ত সচিব মিজানুর রহমান বলেন, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ কেন থামানো যাচ্ছে না-জানতে চাইলে তিনি বলেন, আরাকান আর্মি চক্রান্ত করছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। অনেক সময় মানবিক কারণে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া দেশীয় দালালদের সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ আছে। তিনি বলেন, যে হারে রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা বাড়ছে, একপর্যায়ে স্থানীয়রা কোণঠাসা হয়ে যেতে পারেন।

উল্লেখ্য, কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার ৩৩টি ক্যাম্পে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার বসবাস। এছাড়া নোয়াখালীর হাতিয়ায় অবস্থিতে ভাসানচরের আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাস করছেন প্রায় ৩৭ হাজার রোহিঙ্গা। মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে তারা বিভিন্ন সময়ে টেকনাফ ও উখিয়ার ক্যাম্পগুলোয় আশ্রয় নেন। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা ব্যাপক হারে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তাদের অনুপ্রবেশ এখনো চলছে। তবে বন্ধ আছে তাদের রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম। রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও ক্যাম্পগুলোর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ২০২০ এপিবিএনের দুটি ইউনিট কাজ শুরু করে। ২০২১ সালে বাড়ানো হয় আরও দুটি ইউনিট। এ চারটি ইউনিটের নেতৃত্বে আছেন একজন ডিআইজি। তিনি ডিআইজি; শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন (এফডিএমএন) হিসাবে পরিচিত। এছাড়া দায়িত্ব পালন করছেন এফডিএমএন কমিশনার। ডিআইজি (এফডিএমএন) ও এফডিএমএন কমিশনারের কার্যালয় কক্সবাজার শহরে অবস্থিত। এফডিএমএন-এর প্রধান হিসাবে আছেন একজন অতিরিক্ত সচিব।

এফডিএমএন-এপিবিএন ছাড়াও ক্যাম্পগুলোয় জেলা পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), র‌্যাব, আনসার এবং ম্যাজিস্ট্রেটের সমন্বয়ে মাঝেমধ্যে যৌথ অপারেশন পরিচালনা করা হয়। চলে ফুট প্যাট্রোলিং, মোবাইল প্যাট্রোল ডিউটি। ওয়াচ টাউয়ারের মাধ্যমে মনিটরিং করা হয় রোহিঙ্গাদের কার্যক্রম। জরুরি প্রয়োজনে রয়েছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কুইক রেসপন্স টিম। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে চালানো হয় বিশেষ অভিযান। কমিউনিটি ও বিট পুলিশিং কার্যক্রম চলে নিয়মিতভাবে।

প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর-১১ মাসে ১০৯টি অস্ত্র মামলায় ১৩৮ জন রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করেছেন এপিবিএন সদস্যরা। ১৫৪টি মাদক মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ১৮৫ জনকে। ৪৪টি হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন ২৯ রোহিঙ্গা। ওই ১১ মাসে অন্যান্য ঘটনায় আরও ৩৮৮ রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করেছে এপিবিএন। গত চার বছরের হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি ৭৩টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ২০২০ সালে ১০, ২০২১ সালে ৩০, ’২২ সালে ৩১ এবং ’২৪ সালে ৫৮টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

জানতে চাইলে এপিবিএন ডিআইজি (এফডিএমএন) প্রলয় চিসিম যুগান্তরকে বলেন, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা এবং ব্যবসার টাকা ভাগবাঁটোয়ারাকে কেন্দ্র করেই মূলত রোহিঙ্গাদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। এছাড়া ভূরাজনৈতিক কারণ তো আছেই। কীভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা চলছে-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্যাম্পগুলোর অবস্থান মিয়ানমার সীমান্তের দুই-চার-পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে। পুরো সীমান্তে তো সব সময় পাহারা দেওয়া সম্ভব হয় না। সীমান্ত রক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্তদের দুর্বলতা এবং কিছু স্থানীয় অপরাধীর যোগসাজশেই ওপার থেকে মাদক-অস্ত্র আসছে। এক প্রশ্নের জবাবে ডিআইজি বলেন, গত সাত মাসেও ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা দেশে ঢুকেছে। এত কড়াকড়ির মধ্যেও কীভাবে রাহিঙ্গারা আসছে-জানতে চাইলে বলেন, ওপারে রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা-নির্যাতন চলছে। জীবন বাঁচাতে কেউ কেউ ঢুকে পড়ছে। মানবতার খাতিরে কখনো কখনো আশ্রয় দিতে হচ্ছে। এছাড়া স্থানীয় কিছু দালালের মাধ্যমেও তারা ঢুকছে। তিনি আরও বলেন, ক্যাম্পগুলোয় রেজিস্ট্রেশনকৃত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ। বাস্তবে আরও বেশি রোহিঙ্গা আছে। অনেকদিন ধরে রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম বন্ধ। সাম্প্রতিক সময়ে যারা আসছে, তারা রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রমের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, প্রতিবছর জন্ম নিচ্ছে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু। ২০১৭ সালেই এসেছে ১০ লাখ রোহিঙ্গা। ওই সময় থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ধরলে আট বছরে বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছে প্রায় আড়াই লাখ শিশু। যে হারে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বাড়ছে, একসময় তারাই গোটা এলাকায় সংখ্যাঘরিষ্ঠ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এটি ভবিষ্যতে ভূরাজনীতির জন্য বড় সমস্যা হতে পারে। রোহিঙ্গাদের কারণে ইতঃপূর্বে স্থানীয়ভাবে কী কী সমস্যা হয়েছে-জানতে চাইলে বলেন, এলাকটি ছিল পাহাড়। তাদের কারণে পাহাড় কাটতে হয়েছে। বন ধ্বংস করতে হয়েছে। এতে পরিবেশগত বড় ক্ষতি হয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবসন ছাড়া সমস্যার সমাধান হবে না বলে জানিয়ে ডিআইজি প্রলয় চিসিম বলেন, যেভাবেই হোক তাদের প্রত্যাবাসন করতে হবে। সুত্র, যুগান্তর

পাঠকের মতামত

কক্সবাজারে মাদরাসা ছাত্রীর মাথা ফাটালেন এলজিইডির অফিস সহকারী

কক্সবাজারের পেকুয়ায় মাদরাসা ছাত্রীকে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগ উঠেছে আহসান উল্লাহ নামে পেকুয়া উপজেলা প্রকৌশলী ...

কোরআনের শাসন ছাড়া মানবতার মুক্তি সম্ভব নয়-মুহাম্মদ শাহজাহান

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ শাহজাহান বলেছেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছর ধরে মানুষের ...

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১ হাজার শিক্ষাকেন্দ্র বন্ধ

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোতে তহবিলসংকটের মুখে পড়েছে শিক্ষা কার্যক্রম–সংশ্লিষ্ট একাধিক বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)। ইতিমধ্যে এক হাজারের ...