গুজব ছড়িয়ে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এ বিষয়ে দেশটির বিরুদ্ধে গণহত্যার ৩০ লাখ তথ্য ও প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক আদালতের কাছে দেওয়া হবে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় গত সোমবার জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ৫১তম নিয়মিত সেশনে এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানান জাতিসংঘের ইনডিপেনডেন্ট ইনভেস্টিগেশন মেকানিজম ফর মিয়ানমারের (আইআইএমএম) প্রধান নিকোলাস কৌমজিয়ান। আইআইএমএমের প্রধান বলেন, আমরা যে তথ্যগুলো সংগ্রহ করেছি, তা বিশ্নেষণ করা এখন সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ।
উদাহরণস্বরূপ ফেসবুক আমাদের লক্ষাধিক উপাত্ত দিয়েছে, যা তারা সরিয়ে ফেলেছে। কারণ ফেসবুকের যে অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে এগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাদের পরিচয় ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর এ অ্যাকাউন্টগুলো মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করত। আমরা এমন অনেক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট শনাক্ত করতে পেরেছি, যার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক ও ভয়ের পরিস্থিতি তৈরি করেছিল।
তিনি বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা নিধন কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগে ২০১৭ সালের ১০ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগের একটি মাধ্যম থেকে দশটি ভিন্ন ভিন্ন পোস্ট প্রকাশ করা হয়। যাতে রোহিঙ্গাদের নিয়ে অপপ্রচার করা হয়েছিল। এগুলোতে মিয়ানমারের বৌদ্ধদের হুমকি, একটি গরুর পেট কাটা ছবি এবং ধারালো কিছু দিয়ে খোঁচানোর মতো ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, যা মিয়ানমারের বৌদ্ধদের জন্য একটি অবমাননাকর ছিল। যার সবই মিথ্যা ও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর জন্য করেছিল সামরিক জান্তা।
নিকোলাস কৌমজিয়ান বলেন, তদন্ত ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে গিয়ে আইআইএমএম বহু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছে। মিয়ানমার আমাদের অপরাধ সংঘটনের স্থান পরিদর্শন এবং সাক্ষীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেয়নি। আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটনের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তের জন্য মিয়ানমারের কাছে অনেকবার অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাঁদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এ প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমাদের তদন্তে উল্লেখজনক অগ্রগতি হয়েছে। অনেক সাহসী ব্যক্তি, এনজিও এবং অন্যরা নিজ থেকে এসে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ দিয়েছে। মিয়ানমারের ভেতর যারা এ ঘটনাগুলোর সাক্ষী, তাদের আমরা অসংখ্য সাক্ষাৎকার নিয়েছি- এ ক্ষেত্রে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আইআইএমএম প্রমাণভিত্তিক ও বিশ্নেষণধর্মী ৬৭টি প্যাকেজ প্রস্তুত করেছে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) এবং আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে (আইসিজে) সরবরাহ করা হবে। এখন আমরা আর্থিক বিশেষজ্ঞদের দলে যুক্ত করেছি, যারা আর্থিক বিষয়াদি তদন্ত করে আমাদের সহযোগিতা করবে। আমাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রায় ২০০ সূত্র থেকে ৩০ লাখ তথ্য ও প্রমাণ সংগ্রহ করেছি, তা উল্লেখ করা হয়েছে। যাতে সাক্ষাৎকার, নথি, ভিডিও, ছবি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথ্য এবং ভৌগোলিক চিত্র রয়েছে। প্রতিবেদন খসড়া করার পরও দ্বিগুণ হারে এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত আসা শুরু করেছে।
জাতিসংঘের এ প্রতিনিধি বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এখনও মিয়ানমারে আন্তর্জাতিক অপরাধ দিন দিন তীব্র হচ্ছে। জবাবদিহির অভাবের কারণে দেশটির জনগণের দুর্ভোগ অব্যাহত রয়েছে। সেনাবাহিনীর রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নিধন অভিযান পাঁচ বছর অতিক্রম করেছে। নিরাপদ ও স্বাভাবিক অবস্থার জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোতে বর্তমানে অপেক্ষা করছেন রোহিঙ্গারা।
তিনি আরও বলেন, ধর্ষণ, নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতার দিকে আমরা বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। মা-বাবাকে ধরতে গিয়ে মিয়ানমারের অনেক শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের অন্যায়ভাবে আটক করা হয়েছে, সেই প্রতিবেদন আমরা সংগ্রহ করেছি। এ ছাড়া সেখানে নারী ও পুরুষের ওপর যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছে, সেই প্রমাণও আমাদের কাছে রয়েছে। মিয়ানমারে যারা গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধ করেছে, তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে।