রোহিঙ্গা গণহত্যার মামলায় ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) কাগজপত্র ও নথি জমা দেয়ার জন্য সময় ১০ মাস বাড়ানোর আবেদন করেছিল মিয়ানমার। সেই আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন আদালত। এর পরিবর্তে দেশটিকে এক মাস সময় বাড়িয়ে দিয়েছেন বিচারক।
আগামী ২৪ এপ্রিল যুক্তিতর্ক খণ্ডন নথি (কাউন্টার মেমোরিয়াল) জমা দেয়ার তারিখ ছিল মিয়ানমারের। কিন্তু গত ১৪ মার্চ এক আবেদনে তারা জানায়, তাদের অর্থনৈতিক সংকট এবং মিয়ানমারের ভাষায় লেখা নথি ইংরেজিতে অনুবাদ করার জন্য তাদের ১০ মাস সময় দরকার।
সময় বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কাউন্টার মেমোরিয়াল জমা দিতে চায় তারা।মিয়ানমার মার্চে যখন সময় বৃদ্ধির আবেদন করে ওই সময়ে চীনের সহযোগিতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন পাইলট প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা চলছিল।
আদালত এ বিষয়ে মামলার বাদী গাম্বিয়ার মতামত জানতে চাইলে দেশটি এর বিরোধিতা করে জানায়, অনুবাদ করার জন্য অথবা অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সময় বৃদ্ধি করার নজির নেই। এছাড়া এর আগে মিয়ানমার নির্দিষ্ট সময়ে তাদের নথি জমা দিয়েছে। এবার সময় বাড়ানো হলে সেটি মিয়ানমারের জন্য সুবিধাজনক হবে না। সবকিছু বিবেচনা করে আদালত মিয়ানমারকে এক মাস সময় বাড়িয়ে ২৪ মে তাদের নথি জমা দেয়ার আদেশ দিয়েছেন।
২০১৯-এর নভেম্বরে গাম্বিয়া ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করে। গাম্বিয়ার মামলা করার অধিকার ও যোগ্যতা নিয়ে মিয়ানমার প্রশ্ন উঠালে প্রাথমিক শুনানির পর কোর্ট গাম্বিয়ার পক্ষে রায় দেন। এরপর গাম্বিয়া ও মিয়ানমার একাধিক সময়ে তাদের নথি জমা দিয়েছে।
যেসব আপত্তি জানিয়েছিল মিয়ানমার : মিয়ানমারের বক্তব্য ছিল, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় গ্রহণের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যেহেতু আইসিজেতে মামলা করেনি, তাই গাম্বিয়া কোনোরকম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ না হয়ে মামলা করার অধিকার রাখে না। সেই সঙ্গে দেশটি আরো আপত্তি তুলেছিল যে, গাম্বিয়া অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনের (ওআইসি) ছায়া হয়ে মামলা করেছে। কিন্তু আইসিজের নিয়ম অনুযায়ী, যে কোনো রাষ্ট্র মামলা করতে পারে, জোট নয়।
মিয়ানমার ও গাম্বিয়া- দুই পক্ষের মধ্যে কোনো বিরোধ ছিল না বলে মামলাটি আদালতে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বলে দাবি করেছিল দেশটি। এছাড়া মিয়ানমার নিজেরাও জাতিসংঘের গণহত্যা কনভেনশনের ৯ অনুচ্ছেদ স্বাক্ষর করেনি বিধায় এই আদালতের মামলা গ্রহণের অধিকার নেই বলেও মিয়ানমার আপত্তি তুলেছিল।
রায়ে আদালত যা বলেছে :
মিয়ানমারের এসব আপত্তির বিষয়ে আইসিজে সভাপতি বিচারক জোয়ান ই দোনোঘুই রায়ে বলেন, গণহত্যা সনদে স্বাক্ষরকারী যে কোনো দেশ অন্য দেশের গণহত্যা প্রতিকারের স্বার্থে মামলা করতে পারে, তার অধিকার ক্ষণ্নœ হয় না। গাম্বিয়া কোনো জোটের ছায়া হয়ে নয়, নিজের সিদ্ধান্তেই মামলা করেছে বলে আদালত নিশ্চিত হয়েছেন। গণহত্যা সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে দায়িত্ববোধ থেকেই গাম্বিয়া আদালতে এসেছে। সেই সঙ্গে মামলা করার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা জোটের কাছ থেকে আর্থিক বা রাজনৈতিক সহায়তা নেয়ার অধিকার গাম্বিয়ার আছে।
দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ ছিল না বলে যে আপত্তি তোলা হয়, তা-ও খারিজ করে দেন আদালত। কারণ গাম্বিয়া ২০১৮ ও ২০১৯ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মিয়ানমারের গণহত্যার বিষয়টি তুলে ধরে বক্তব্য দিয়েছে। যেখানে মিয়ানমারও পাল্টা বক্তব্য দিয়েছে। মামলা করার পূর্বে মিয়ানমারের কাছে কূটনৈতিক চিঠিও পাঠিয়ে গণহত্যা বন্ধ করার দাবি জানিয়েছিল গাম্বিয়া। মিয়ানমার তার কোনো জবাব দেয়নি। সেই সঙ্গে মিয়ানমার গণহত্যা সনদ অনুসমর্থন করেনি বলে যে আপত্তি তুলেছে দেশটি, সেই প্রসঙ্গে আদালত বলেছেন, এতে আদালতের এখতিয়ার ক্ষুণ্ন হয়নি। ফলে আদালত মিয়ানমারের আপত্তি নাকচ করে দেন।
মামলার ইতিবৃত্ত :
২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মুখে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সবমিলিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। এই নৃশংসতাকে গণহত্যা আখ্যা দিয়ে ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর আইসিজেতে মামলা দায়ের করে আফ্রিকার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ গাম্বিয়া। অভিযোগে গাম্বিয়া বলেছে, রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস সামরিক অভিযান চালানোর মাধ্যমে ১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ লঙ্ঘন করেছে মিয়ানমার। গণহত্যার তদন্ত শুরু না হওয়া পর্যন্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জরুরি ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানায় দেশটি।
পাঠকের মতামত