বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কোনো যৌক্তিক কারণ না দেখিয়ে পরামর্শক খাতে চার কোটি ৪৭ লাখ টাকা খরচের ছক কষেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। এরই মধ্যে প্রকল্পের প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। আগে বাস্তবায়ন হয়েছে এমন ধরনের প্রকল্পে ফের পরামর্শক ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কমিশন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ‘বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং স্থানীয় জনসমাজের সমন্বিত সেবা ও জীবন-জীবিকা উন্নয়ন’ প্রকল্পে পরামর্শক খাতে ব্যয়ের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তার কোনো ব্যয় বিভাজন দেওয়া হয়নি। যৌক্তিক পর্যায়ে ব্যয় কমানোর সুপারিশ দিয়েছে কমিশন। তাছাড়া প্রকল্পে পাঁচ ধরনের পরামর্শক সেবার সংস্থান রাখা হয়েছে। এগুলোর বিস্তারিত তথ্যও চেয়েছে কমিশন।
প্রকল্পের আরও কিছু প্রস্তাবনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। রাজস্ব খাতে প্রকল্প পরিচালকের অফিস ভবনসহ অন্য ভবনের জন্য স্যানিটেশন অ্যান্ড ওয়াটার সাপ্লাই খাতে ১০ কোটি টাকার ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি অত্যধিক প্রমাণিত হয়েছে বলে দাবি কমিশনের। মূলধন খাতের আওতায় নতুন কার্যক্রম, রিপেয়ার ও রিহ্যাবিলিটেশন কাজের কোনো ব্যয় বিভাজন প্রকল্পের দলিলে সংযুক্ত নেই। এক্ষেত্রে ব্যয় প্রাক্কলনের ভিত্তি উল্লেখ করে বিস্তারিত ব্যয় বিভাজন প্রস্তুতকারীদের নাম-পদবিসহ প্রকল্পে সংযুক্ত করতে বলেছে কমিশন।
এছাড়া ফার্নিচার বাবদ ৫০ লাখ, কম্পিউটার সামগ্রী খাতে ৬০ লাখ, সিসি ক্যামেরার জন্য ২৫ লাখ ও অফিস সেটআপের জন্য ৬০ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটাও অত্যধিক বলে দাবি কমিশনের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পরিকল্পনা) এহতেশামুল রাসেল খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পটি নিয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা হয়েছে। আমাদের একটি গাইডলাইন আছে। সে অনুযায়ী ব্যয়প্রস্তাব করা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন ও আমাদের গাইডলাইন একই।’
ডিপিএইচই সূত্র জানায়, প্রকল্পের মোট প্রস্তাবিত ব্যয় ৬৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ১৬৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা, বাকি অর্থ বিশ্বব্যাংকের ঋণ অনুদান। জানুয়ারি ২০২৫ থেকে ডিসেম্বর ২০২৭ মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। বাস্তবায়ন এলাকা কক্সবাজার জেলার উখিয়া, টেকনাফ, কক্সবাজার সদর, রামু, পেকুয়া, মহেশখালী, চকরিয়া ও ঈদগাঁও, নোয়াখালীর হাতিয়া ও সুবর্ণচর উপজেলা। উখিয়া, টেকনাফ ও ভাসানচরে স্থানান্তর পরবর্তী বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের ক্যাম্পেও এটা বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রকল্প প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের যুগ্ম প্রধান মোহাম্মদ আবুল হাশেম জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পটি নিয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা হবে। এর আগে আমরা প্রকল্পের কিছু ব্যয় নিয়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছি। আমাদের কাছে মনে হয়েছে ব্যয় বেশি ধরা হয়েছে। সভায় ডিপিএইচইর বক্তব্য আমরা শুনবো। তারা যদি যৌক্তিক উত্তর দিতে পারে তবে ব্যয় বিবেচনা করা হবে, আর না দিতে পারলে বাদ।’
প্রকল্প এলাকায় বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের নিরাপদ, টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক পানীয় জল সরবরাহ, স্যানিটেশন এবং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিষেবার ব্যবহার নিশ্চিত করা।
এছাড়া বিদ্যমান পাইপ ওয়াটার সাপ্লাই ব্যবস্থার পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ অব্যাহত রাখা, ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, পালংখালী, উখিয়ার সারফেস ওয়াটার রিজার্ভারের উন্নয়ন, পালংখালী ভূ-উপরিস্থ পানি শোধনাগার প্ল্যান্ট নির্মাণকাজ, উখিয়া থেকে টেকনাফ পৌরসভায় নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য পাইপলাইন স্থাপন এবং টেকনাফ পৌরসভায় পানি সরবরাহের জন্য গৃহ-সংযোগ দেওয়া।
ডিপিএইচই জানায়, টেকনাফ পৌরসভায় এখন পর্যন্ত কোনো উপযুক্ত পানির উৎস পাওয়া যায়নি। এক্ষেত্রে উখিয়া উপজেলার পালংখালীতে স্থাপিত বৃষ্টির পানির রিজার্ভার থেকে টেকনাফ পৌরসভা পর্যন্ত পানি সঞ্চালন লাইন স্থাপনের মাধ্যমে পৌরসভায় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করার সংস্থান নতুন প্রকল্পে রাখা হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে উন্নত স্বাস্থ্যবিধি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করে পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থায় নারীদের উপযুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা হবে।
প্রকল্পটিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় ৫০০টি গোসলখানা স্থাপন, ৪০টি সৌরশক্তিচালিত ভূ-গর্ভস্থ ও চারটি ভূ-উপরিস্থ জলাধার থেকে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা স্থাপন ও পরিচালনা, পাঁচটি সমন্বিত কঠিন এবং মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্থাপন ও পরিচালনা করা হচ্ছে। ১০০টি সমন্বিত স্যানিটেশন ব্যবস্থা স্থাপন, ৫০টি মিনি ও ১০০টি ন্যানো গ্রিড সৌর সিস্টেমের মাধ্যমে রাস্তা ও গৃহে বাতি সংযোগ কার্যক্রম মেরামত, ৩৮টি বজ্র নিরোধক টাওয়ার স্থাপন এবং হোস্ট কমিউনিটির জন্য ১০০টি সমন্বিত স্যানিটেশন ব্যবস্থা স্থাপন, কক্সবাজার পৌরসভার জন্য ১০০০ ঘনমিটার প্রতি ঘণ্টা ক্ষমতার নদীর পানি শোধনাগার, সঞ্চালন লাইন, ৪০ লাখ লিটার ধারণক্ষমতার একটি ওভারহেড রিজার্ভার, প্রতিটি ৭ লাখ লিটার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন চারটি ওভারহেড ট্যাংক, পরিচালন পাইপলাইন ও প্রায় ৫০০০টি গৃহসংযোগসহ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা স্থাপন এবং কক্সবাজার পৌরসভার জন্য সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্থাপন করা হচ্ছে।
এছাড়া উখিয়ার পালংখালীতে প্রায় ৫০ একর জায়গায় স্থাপিত বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ জলাধার স্থাপন করা হচ্ছে, যা থেকে ভবিষ্যতে পরিচালন লাইনের মাধ্যমে টেকনাফ পৌরসভায় পানি সরবরাহ ব্যবস্থা করা হবে।
জাগো নিউজ