উখিয়া নিউজ ডেস্ক::
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সারা দেশে শুরু হয়েছে ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ কার্যক্রম। এবার ভোটা তালিকা হালনাগাদে সবচেয়ে বড় বিভ্রান্তি ও সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে সম্প্রতি বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। নির্বাচন কমিশন (ইসি) বলছে, রোহিঙ্গারা যাতে ভোটার তালিকায় অন্তভুক্ত না হতে পারে সে জন্য বিশেষ নজরদারি রাখা হবে। কিন্তু সেই নজরদারি কোন পর্যায়ের, কিংবা সেটি বাস্তবিক অর্থে কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিশেষজ্ঞ মহলে। স্থানীয় সরকার বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের ভোটার হলে পার্বত্য এলাকার নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর হয়ে পড়বে তারা।
তবে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে খুব সতর্ক অবস্থান নেয়া হয়েছে বলে বারবারই বলছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বলেও জানা গেছে।
গত ২৫ জুলাই থেকে সারা দেশ বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। এটি চলবে ৯ আগস্ট পর্যন্ত। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে যাদের বয়স ১৮ হবে এবং যেসব নাগরিক যোগ্য হওয়ার পরও বিভিন্ন কারণে ভোটার হতে পারেননি কেবল তাদের ভোটার তালিকায় অন্তভুক্ত করা হবে।
জানা গেছে, নির্বাচনের আগে ভোটার হালনাগদের সময় অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা ভোটার হওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। কৌশলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কিছু সদস্য ভোটারও হয়ে যান। আর সেক্ষেত্রে স্থানীয় প্রতিনিধিরাও রোহিঙ্গাদের ভোটার বানিয়ে ব্যালট বাক্স ভারি করায় ব্যস্ত হয়ে উঠে।
বাংলাদেশে কী পরিমাণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রয়েছে তার কোনও নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তবে ধারণা করা হচ্ছে প্রায় ৩ লাখের মতো রোহিঙ্গা পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় অবৈধভাবে বসবাস করছেন।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে ভোটার হালনাগাদের সময় কৌশলে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের অনেকই ভোটার নিবন্ধন করেন। পরে তারা নিজেদের বাংলাদেশের নাগরিক বলে দাবি করেন। এক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা নিজের ভোট ব্যাংক বৃদ্ধি করার জন্য রোহিঙ্গাদের ভোটার করার চেষ্টা করে থাকে বলে অনেক সময় অভিযোগ ওঠে।
এ বিষয়ে পরামর্শ হিসেবে বলা হচ্ছে, রোহিঙ্গারা যেন কোনওভাবে ভোটার হতে না পারে সেজন্য ইসি ও স্থানীয় প্রশাসন মিলে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফয়েল আহম্মেদ বলেন, ‘রোহিঙ্গারা দেশের কোথায় কিভাবে বাস করছে তার সঠিক কোনও পরিসংখ্যান নেই। তাই এ সংখ্যা আমাদের জানা দরকার। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। এসব এলাকায় ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের কোথায় বাড়ি ঘর, পূর্বপুরুষদের বাড়ি কোথায় এসব তথ্য সংগ্রহ করতে পারলে ভাল হয়।’
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের যতটুকু মানবিক সাহায্য প্রয়োজন তা করতে হবে। কিন্তু নজর রাখতে হবে তারা যেন কোনওভাবে ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে না পারে। কেননা তালিকায় না উঠে গেলে তারা তখন বাংলাদেশের নাগরিক বলে নিজেদের দাবি করে বসবে। তাই এক্ষেত্রে ইসি ও স্থানীয় প্রশাসনকে বিশেষভাবে সজাগ থাকতে হবে।’
অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের অনেকেই ভোটার তালিকায় নাম লিখিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা নিজের ভোট ব্যাংক বৃদ্ধি করার চেষ্টা করে থাকে বলে অনেক সময় অভিযোগ উঠে থাকে। এ বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে সমাধান করা দরকার। কিন্তু কীভাবে? জানতে চাইলে ড. তোফয়েল আহম্মেদ বলেন, ‘অনেক স্থানীয় জনপ্রতিনিধি চাইবে রোহিঙ্গাদের ভোটার করাই, যাতে তার ভোট ব্যাংক ভারি হয়। সুতরাং এটি চেক দিতে হবে।’
তার ভাষ্য, ‘স্থানীয় যারা নির্বাচন করেন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত তাদের শুধু আগ্রহ রয়েছে ভোট পাওয়ার, ভোট আদায়ের, ভোট চুরির। গোটা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে তাদের কোনও মাথা ব্যাথা নেই। তাই রোহিঙ্গারা যাতে কোনওভাবেই ভোটার হতে না পারে সেজন্য ইসি ও স্থানীয় প্রশাসনকেই যৌথভাবে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে।’
ইসি কর্মকর্তারা ব্রেকংনিউজকে জানান, দেশের যেসব এলাকায় রোহিঙ্গা বসবাস করছেন সেসব এলাকার জনগণকে ভোটার তালিকায় যুক্ত করার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হবে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে রোহিঙ্গা নাগরিকদের নিবন্ধন ঠেকানো। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এসব বিশেষ এলাকায় ভোটার হতে হলে আত্মীয়-স্বজন বিশেষ করে বাবা-মা, ফুফু, চাচার জাতীয় পরিচয়পত্র লাগবে।
রোহিঙ্গা নাগরিকদের ভোটার হওয়া ঠেকানো দেশের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত চার জেলার ৩০টি উপজেলার বিশেষ নজরে রেখেছে ইসি। এসব বিশেষ এলাকার মধ্যে কক্সবাজার জেলার ৮টি, বান্দরবানের ৭টি, রাঙামাটির ৮টি ও চট্টগ্রামের ৭টি উপজেলা রয়েছে।
উপজেলাগুলো হলো- কক্সবাজার সদর, চকোরিয়া, টেকনাফ, রামু, পেকুয়া, উখিয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া। বান্দরবান সদর, রুমা, থানচি,বোয়াংছড়ি, আলীকদম, লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি। রাঙামাটি সদর, লংগদু, রাজস্থলী, বিলাইছড়ি, কাপ্তাই, বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি ও বরকল। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারা, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগড়া ও বাঁশখালী।
ইসি সূত্র আরও জানায়, আগে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত বিশেষ উপজেলা ছিল ২০টি। এবার আরও ১০টি উপজেলা চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ৩০টি এলাকার জন্য বিশেষ কমিটি করা রয়েছে। রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়া ঠেকাতে এসব এলাকায় বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এসব এলাকায় কেউ ভোটার হতে চাইলে তাকে কমিটির কাছে মা-বাবা, ফুফু-চাচার এনআইডি দেখাতে হবে। এসব না থাকলে কিংবা বিদেশি নাগরিকত্বের প্রমাণ পেলে তাকে ভোটার করা হবে না।
রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় বিশেষ কমিটি:
রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার বিশেষ কমিটির ১৪ জন সদস্য হলেন- উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার(ভূমি), থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের প্রতিনিধি,প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি, স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রতিনিধি, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ(পার্বত্য জেলার ক্ষেত্রে), হেড ম্যান (পার্বত্য জেলার ক্ষেত্রে), কারবারি (পার্বত্য জেলার ক্ষেত্রে) ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান।