মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন :
রোহিঙ্গা ভোটার ঠেকাতে পুরো চট্টগ্রাম জেলাকে ‘বিশেষ জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা আশ্রিত জেলা কক্সবাজার এবং বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি তিন পার্বত্য জেলাকেও বিশেষ জোন এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। এই পাঁচ জেলার বাসিন্দাদের ভোটার হতে এখন গলদঘর্ম অবস্থা।
তবে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, পাঁচ জেলাকে বিশেষ জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও এবার বিশেষ ছাড়ও রয়েছে। তিন ক্যাটাগরির ভিত্তিতে ভোটার তালিকা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি।
চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. ইউনুচ আলী বলেন, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলাকে রোহিঙ্গাপ্রবণ এলাকা হিসেবে বিশেষ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে ভোটারইচ্ছুকদের পূর্বের মতো দুর্ভোগ পোহাতে হবে না। এজন্য তিনটি ক্যাটাগরি নির্ধারণ করা হয়। যাদের এসএসসি পরীক্ষার সনদ রয়েছে তারা ‘এ’ ক্যাটাগরির ভিত্তিতে ভোটার হতে পারবেন। যাদের সনদ নেই তারা ‘বি’ ক্যাটাগরিতে ভোটার হবেন। অন্যরা আগের মতো বিশেষ কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে ভোটার হবেন।
নির্বাচন কমিশন জানায়, যাদের জন্ম ২০০৭ সালের ১ জানুয়ারি বা তার পূর্বে এবং বিগত হালনাগাদে যারা বাদ পড়েছেন তারা ভোটর হতে পারবেন। এ ছাড়া যারা অন্য কোনো কারণে ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি, তারা আগামী ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখের মধ্যে সংশ্লিষ্ট উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসে গিয়ে ভোটার হতে পারবেন।
ভোটার হতে যেসব কাগজপত্র লাগবে: ১৭ ডিজিটের অনলাইন জন্মসনদের কপি। জাতীয়তা/নাগরিকত্ব সনদের কপি। নিকট আত্মীয়ের (পিতা-মাতা, ভাই-বোন প্রভৃতি) এনআইডির ফটোকপি, এসএসসি/দাখিল/সমমান অথবা অষ্টম শ্রেণি পাসের সনদের কপি (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), ইউটিলিটি বিলের কপি (বিদ্যুৎ/গ্যাস/পানি/চৌকিদারি ট্যাক্স রশিদের ফটোকপি)।
এবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদের তথ্য সংগ্রহ করছে না নির্বাচন কমিশন। তাই সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কার্যালয়ে গিয়ে ভোটার হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে ইসি। সর্বশেষ ২০২২ সালে নির্বাচন কমিশন বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করেছিল। ওই সময় ২০০৭ সালের ১ জানুয়ারি যাদের জন্ম তাদের তথ্যও সংগ্রহ করা হয়েছিল। আগামী ১ জানুয়ারি তাদের ১৮ বছর পূর্ণ হবে।
চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ইউনুচ আলী বলেন, ২ জানুয়ারি খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। তাই ২০০৭ সালের ১ জানুয়ারি যাদের জন্ম বা যারা এখনো ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করেনি, তাদের সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কার্যালয়ে গিয়ে ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে ইসি। ১৮-৩০ জানুয়ারি সংশোধন শুনানি শেষে ২ মার্চ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে।
রোহিঙ্গা নাগরিক ভোটার করা: কক্সবাজারের টেকনাফ রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেক রোহিঙ্গা চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। বহু রোহিঙ্গা ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত হয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট পর্যন্ত সংগ্রহ করেছে। ২০১৯ সালে চট্টগ্রামে রোহিঙ্গা নাগরিকের ভোটার হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে আসে। ওই বছরের ২৪ জুলাই রোহিঙ্গা নারী রমজান বিবি ওরফে লাকী মির্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাতীয়তা সনদ পান। মূলত হাটহাজারীর আবদুস সালাম কথিত বাবা সেজে লাকীকে এনআইডি, জাতীয়তা সনদ পেতে সহায়তা করেন।
২০১৯ সালে টেকনাফে নিহত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নুর আলম (প্রকাশ নুরু ডাকাত) নগরীর জয়নাব কলোনির এলাকার ঠিকানা ব্যবহার করে এনআইডি নিয়েছিলেন। রোহিঙ্গাদের এনআইডি কার্ড করে দেয়ার নেপথ্যে ছিল বড় সিন্ডিকেট। জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতির মামলা তদন্ত করতে হিয়ে ৫৫ হাজার ৩১০ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দেওয়া হয়েছিল বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে ওঠে এসেছিল। নির্বাচন কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামও উঠে এসেছিল দুদক ও পুলিশের তদন্তে। এসব ঘটনায় অন্তত ১৮টি মামলা দায়ের হওয়ার তথ্য মিলেছে।
২০১২ সালে চন্দনাইশ নির্বাচন কার্যালয় থেকে চারটি ল্যাপটপ হারিয়ে যায়। এছাড়া ২০১৫ সালে মিরসরাই উপজেলায় হালনাগাদ কাজে ব্যবহৃত একটি ল্যাপটপ ঘায়েব হয়ে যায়। ২০১৬ সালের পর থেকে রোহিঙ্গা নাগরিকদের জালিয়াতির মাধ্যমে ভোটার করা হচ্ছে বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে উঠে এসেছিল।
বিশেষ এলাকায় ভোটার: বিশেষ এলাকা হিসেবে ভোটার হতে ১৮ ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে হবে। এসব কাগজপত্র জমা দিয়ে ভোটার হওয়া মানে অনেকটা গলদঘর্ম অবস্থা ভোটার-ইচ্ছুক নাগরিকদের। তবে তিন ক্যাটাগরির ভিত্তিতে কাগজপত্র জমা দিয়ে ভোটার হওয়ার সুযোগ রেখেছে নির্বাচন কমিশন।
আরও খবর