কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নিরাপত্তা হুমকিতে রয়েছে বিভিন্ন সময়ে সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত রোহিঙ্গাদের পরিবারের সদস্যরা। সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত স্বজনদের বিচার চাইলে পরিবারের সদস্যদের দেওয়া হয় নানান হুমকি-ধমকি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কোনো পরিবারের একজন সদস্য সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ দেওয়ার পরও পরিবারের অন্যরা ঝুঁকিমুক্ত নন, এমনটি দাবি করেছেন সন্ত্রাসীদের হাতে নিহতদের পরিবারগুলো।
গতকাল বৃহস্পতিবার সরেজমিন থাইংখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে জানা যায়, গত মঙ্গলবার উখিয়ার থাইংখালী তাজনিমারখোলা ১৯ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এ ব্লকে সৈয়দ হোসেনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ক্যাম্পের সাধারণ রোহিঙ্গা ও ক্যাম্পে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রাথমিক ধারণা, পিতার হত্যাকারীদের ধরিয়ে দিতে এবং এ সম্পর্কে পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করায় সন্ত্রাসীরা সৈয়দ হোসেনের ওপর ক্ষিপ্ত হয়। পরে সন্ত্রাসীরা তাকেও হত্যা করে। এর আগে তার পিতা জামিল হোসেনকে গুলি করে হত্যা করেছিল সন্ত্রাসীরা। এতে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ক্যাম্পে স্বজন হত্যার বিচার চাওয়া বা পুলিশকে এ বিষয়ে তথ্যগত সহযোগিতা দেওয়াটাও বড় হুমকি।
সর্বশেষ গত শনিবার উখিয়ার ১৩নম্বর থাইংখালী তাজনিমারখোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসীরা গলা কেটে ও ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে ক্যাম্পের হেড মাঝি মোহাম্মদ আনোয়ার ও ব্লক মাঝি মৌলভী মোহাম্মদ ইউনুছকে। এ ঘটনায় উখিয়া থানায় ৩৫ জনকে আসামি করে মামলা করেছে নিহতদ্বয়ের পরিবার। মামলার পরবর্তীতে ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িত ও মামলার এজাহারনামীয় ছয় আসামিকে আটক করতে সক্ষম হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিহত মাঝি মৌলভী মোহাম্মদ ইউনুসের পরিবারের এক সদস্য জানান, ঘটনার পর আসামিদের আটক করতে পুলিশ পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা চায়। পুলিশকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করলে সন্ত্রাসীরা আমাদের পরিবারের ওপর ক্ষিপ্ত হয়। বিভিন্ন অপরিচিত ব্যক্তি বাড়ির আশপাশে সন্ধ্যার পর ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। অচেনা লোকজন এসে পরোক্ষভাবে বলে দেয়, এসব বিষয়ে পুলিশের সাথে সহযোগিতা না করতে। এখন আমাদের পুরো পরিবারই অনিশ্চিত হুমকির মধ্যে রয়েছে।
এ বিষয়ে ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) এর সহকারী পুলিশ সুপার (অপস অ্যান্ড মিডিয়া) মো. ফারুক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ক্যাম্পে দুষ্কৃতকারীদের হাতে যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা সার্বক্ষণিক নজর রাখছি। তাদের পরিবারের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। এরপরও কোনো পরিবার যদি অতিরিক্ত নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা করে আমাদের জানালে আমরা তার নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
এদিকে একইভাবে রোহিঙ্গা শীর্ষ নেতা মাস্টার মুহিব উল্লাহকে হত্যার পর সন্ত্রাসীদের অব্যাহত হুমকির সম্মুখীন হয়েছিলেন পরিবারের অন্য সদস্যরা। রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের স্বার্থে প্রতিষ্ঠিত সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) এর চেয়ারম্যান মাস্টার মুহিব উল্লাহকে গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বর তার সংগঠনের কার্যালয়ে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তাকে হত্যার পর তার পরিবারের প্রতি ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) এর তীক্ষ্ণ নিরাপত্তা দৃষ্টি স্বত্বেও সন্ত্রাসীদের অব্যাহত হুমকিতে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছিল তার পরিবার। যার প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর তত্ত্বাবধানে মুহিব উল্লাহর পরিবার সংশ্লিষ্ট ২৫ জন সদস্য ৩১ মার্চ ও ২৬ সেপ্টেম্বর দুই দফায় কানাডায় পাড়ি জমান।
রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহকে হত্যার পর সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন ক্যাম্পে আরো ৩২ জন রোহিঙ্গা নেতাকে হত্যা করেছে। নিহতদের বেশির ভাগই বিভিন্ন ক্যাম্প ও ব্লকে নেতৃত্বদানকারী বা সন্ত্রাসী তৎপরতা ঠেকাতে স্বেচ্ছা পাহারায় অংশ নেওয়া স্বেচ্ছাসেবক। ক্যাম্পের সাধারণ রোহিঙ্গারা এসব হত্যাকাণ্ডকে পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত বলে দাবি করেন। এসবের পেছনে তারা স্বশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী সংগঠন আরসাকে দায়ী করে আসছেন।
থাইংখালী তাজনিমার খোলা ক্যাম্পের রোহিঙ্গা এনায়েত উল্লাহ বলেন, সন্ত্রাসীরা খুঁজে খুঁজে সাধারণ রোহিঙ্গাদের নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করছে। তারা রোহিঙ্গাদের নেতৃত্বশূন্য করে পরবর্তী সময়ে তাদের ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। এসব ঘটনায় আরসাই দায়ী। রোহিঙ্গা নেতারা সাধারণ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনসহ বাংলাদেশ সরকারের আইনকানুন মেনে চলার তাগিদ দেন। আরসা সেটা মেনে নিতে পারছে না, কারণ তারা মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে রোহিঙ্গাদের যুগের পর যুগ বাংলাদেশে রাখতে চাচ্ছে। সুত্র: কালেরকন্ঠ