প্রকাশিত: ০৪/০৯/২০১৮ ৪:৩৫ পিএম

তোফায়েল আহমদ, কক্সবাজার ::
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরের পরিস্থিতি ক্রমে পাল্টে যাচ্ছে। উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার ৩০টি শিবির আশান্ত করে তোলার চেষ্টা চলছে।

শিবিরে খুন-রাহাজানি, অপহরণ নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠছে। সর্বশেষ গত রবিবার রাতে বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয় দিয়ে উগ্রপন্থী রোহিঙ্গারা অপহরণ করে ছয়জন নিরীহ রোহিঙ্গাকে। তাদের মধ্যে তিনজনকে গলাকাটা অবস্থায় জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। রোহিঙ্গা শিবিরের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তোলার নেপথ্যে বেশ কিছু এনজিও সক্রিয় রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শিবিরে আনাগোনা বাড়ছে বিদেশিদের।রোহিঙ্গা শিবিরে গোপনে বিদেশিদের আনাগোনায় জঙ্গি তৎপরতার বিস্তার ঘটানোর অভিযোগও পাওয়া গেছে। গত কয়েক দিনে সিরিয়া থেকে বেশ এসে বেশ কিছু লোক রোহিঙ্গা শিবিরে প্রবেশের কথাও জানা গেছে। এ খবর জানার পর গতকাল থেকে সরকারি কর্মকর্তা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা তৎপর হয়ে উঠেছেন। বিদেশিদের নিয়ে কুতুপালং শিবিরের একটি মাদরাসায় গতকাল একটি সভা ডাকা হলেও পরে প্রশাসনিক পদক্ষেপে তা ভণ্ডুল হয়ে যায়।

কুতুপালং ডি-ওয়ান ব্লকের হাফেজ নঈমের মাদরাসায় সভাটি ডাকা হয়েছিল। ওই সভায় সিরিয়া থেকে আসা কয়েকজন থাকার কথা ছিল। কুতুপালং শিবিরের সব মাদরাসায় একই পদ্ধতির আরবি লেখাপড়া করার পরামর্শ সভার কথা বলে শিবিরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছ থেকে সভার অনুমতি নেওয়া হয়েছিল। তবে মাদরাসা পরিচালক রোহিঙ্গা হাফেজ নঈম জানান, কোনো বিদেশি আসার খবর তিনি জানেন না। আমন্ত্রিতদের বেশির ভাগ উপস্থিত না হওয়ায় সভা হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিবিরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত রোহিঙ্গারাই মিয়ানমারের রাখাইনে ‘আল ইয়াকিন’ বা ‘আরসা’ নামের সংগঠনের সদস্য হিসেবে পরিচিত। তাদের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক রয়েছে রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত বেশ কিছু এনজিও কর্মীর সঙ্গে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘বেশ কিছু এনজিও দীর্ঘদিন ধরে তৎপর রয়েছে শিবিরে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটাতে। কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরাসহ প্রশাসনিক তৎপরতার কারণে তাদের তৎপরতা ব্যর্থ হয়েছে। তার পরও জঙ্গিবাদসংশ্লিষ্ট এনজিওগুলো নানাভাবে তৎপর।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, রাখাইনে আল ইয়াকিন ও আরসা নামে পরিচিত সংগঠনের রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে বেশ কিছুসংখ্যক বিদেশি কুতুপালং ও বালুখালী শিবিরে ঢুকে পড়েছে। এরা সিরিয়া থেকে এসেছে বলেও তারা জানতে  পেরেছেন। লোকজনের মুখে তাঁরা শুনেছেন এই বিদেশিরা প্রশিক্ষণ দিতে এখানে এসেছে।

উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিকারুজ্জামান বলেন, ‘গত ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা নির্যাতনের বর্ষপূর্তিতে রোহিঙ্গারা বড় সমাবেশ করতে পেরে একটু বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বাস্তবে তারা এমন কিছুই করতে পারবে না। ’ তিনি বলেন, ‘প্রতিদিনই কর্মকর্তারা রোহিঙ্গা শিবির সরেজমিনে তদারকি করেন। ’

সীমান্তবর্তী এলাকার ৩০টি শিবিরে ১১ লাখ রোহিঙ্গার পর্যাপ্ত খাবার, বাসস্থান ও চিকিৎসাসেবা অব্যাহত থাকলেও পরিস্থিতি কেন অস্থিশীল হয়ে উঠছে, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।

অভিযোগ উঠেছে, গত ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা নির্যাতনের বর্ষপূর্তি এবং ঈদুল আজহা উপলক্ষে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত বেশ কিছু এনজিও গোপনে শিবিরে ঢুকে পড়েছে। এর মধ্যে পাকিস্তানি কয়েকটি এনজিও রয়েছে। ‘আল খিতমাত’ এবং ‘শুরা’ নামে পাকিস্তানভিত্তিক দুটি এনজিও নিয়ে নানা কথা উঠেছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতারা পাকিস্তানভিত্তিক এসব এনজিওর হয়ে রোহিঙ্গা শিবিরে গোপনে কাজ করছে। কিন্তু সরকারি তালিকায় এসব এনজিওর নাম নেই। কিন্তু গোপনে তারা ঠিকই তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রভাষ চন্দ্র শীল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত এনজিওগুলোর তালিকায় পাকিস্তানভিত্তিক কোনো এনজিওর নাম নেই। তবুও বিষয়টি দেখা হচ্ছে। ’

অপহৃত তিন রোহিঙ্গা মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার
টেকনাফের চাকমারকুল রোহিঙ্গা শিবিরসংলগ্ন পাহাড়ি এলাকা থেকে তিন রোহিঙ্গাকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। তিনজনেরই গলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কাটার চিহ্ন রয়েছে। গতকাল সোমবার সকাল ১০টার দিকে টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের চাকমারকুল পাহাড়ি এলাকা থেকে তাদের উদ্ধার করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা হলো বালুখালী শিবিরের ই-ব্লকের নুর আলম (৪৫), মো. আনোয়ার (৩৩) ও কুতুপালং ডি-ব্লকের মো. খালেক (২২)। এ ছাড়া গতকাল দুপুরে আহত খালেকের বাবা অপহৃত মোস্তফাসহ তিনজন পালিয়ে কুতুপালং ক্যাম্প ইনচার্জের অফিসে উপস্থিত হয়েছেন। অন্য দুজনের নাম জানা যায়নি।

টেকনাফ থানার ওসি রণজিৎ কুমার বড়ুয়া জানান, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে রবিবার রাত দেড়টার দিকে একটি সংঘবদ্ধ চক্র বালুখালী ও কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির থেকে ছয়জন রোহিঙ্গাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। অপহৃতদের টেকনাফ উপজেলার চাকমারকুল রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পশ্চিমে গহিন পাহাড়ে আটকে রাখে। একপর্যায়ে অপহরণকারীরা তিনজনের গলায় চুরি চালিয়ে হত্যার চেষ্টা করে। এ সময় রোহিঙ্গাদের চিৎকার শুনে স্থানীয়রা রাখাল রোহিঙ্গা শিবিরে খবর দেয়। পরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে তিনজনকে উদ্ধার করে। পরে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

টেকনাফ থানার ওসি রণজিৎ কুমার বড়ুয়া আরো জানান, তিনি জানতে পেরেছেন রোহিঙ্গাদের মধ্যে পরস্পরবিরোধী দুটি পক্ষ রয়েছে। একটি সাধারণ রোহিঙ্গা, অন্যটি সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা। সন্ত্রাসীরাই সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন-অত্যাচার চালিয়ে আসছে।

অস্ত্রসহ এক রোহিঙ্গা আটক 
টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা জিয়াউর রহমানকে (২২) একটি এলজি ও দুই রাউন্ড তাজা কার্তুজসহ গতকাল ভোরে আটক করা হয়েছে।

সুত্র:কালের কন্ঠ

পাঠকের মতামত