মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে ব্যাপক নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেওয়ার পাঁচ বছর পার হয়ে গেলেও সংকট সমাধানের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে আগ্রহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বরং ফিকে হয়ে আসছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং বাণিজ্যিক স্বার্থের কাছে ঘুরপাক খাচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট।
রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদের কয়েক বছরের মধ্যেই মিয়ানমারে আবারো সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে। যদিও মিয়ানমারে সেনাবাহিনী সবসময়ই সবকিছু পরিচালনা করেছে।
সামরিক সরকার এখন মিয়ানমারে গণতন্ত্র-পন্থী এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর উপর দমন পীড়ন চালাচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এতো কিছুর পরেও মিয়ানমার কিংবা দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো কেন কড়া পদক্ষেপ নিতে পারছে না?
এর বড় কারণ হচ্ছে, মিয়ানমারের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং দেশটির কৌশলগত গুরুত্ব।
চীন, জাপান, রাশিয়া এবং ভারতের সাথে মিয়ানমারের সম্পর্ক বেশ ভালো। এছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক জোট আসিয়ানের সদস্য মিয়ানমার। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সাথেও মিয়ানমারের ভালো সম্পর্ক রয়েছে।
বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দুটি দেশ - চীন এবং রাশিয়া কখনোই মিয়ানমারের বিপক্ষে যায়নি।
চীনের ব্যাপক স্বার্থ
চীনের সাথে মিয়ানমারের ব্যাপক অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্ক আছে।
আমেরিকার হার্ভার্ড ইন্টারন্যাশনাল রিভিউতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে মিয়ানমারের উপর চীনের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব অনেক বেশি।
মিয়ানমারে অবকাঠামো এবং জ্বালানি খাতে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ আছে। তাছাড়া চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হচ্ছে মিয়ানমার।
দশকের পর দশক ধরে অর্থনৈতিক স্বার্থে চীন কখনো মিয়ানমারের সরকারের বিপক্ষে যেতে চায়নি। দেশটিতে যা কিছু ঘটুক না কেন বিনিয়োগ ও ব্যবসার স্বার্থে চীন সেগুলোর বিরুদ্ধে কোন কথা বলেনি।
আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, মিয়ানমারে সামরিক জান্তা ক্ষমতা নেবার পরবর্তী এক বছরে দেশটি ৩৮০ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ অনুমোদন করেছে।
এর মধ্যে ২৫০ কোটি ডলার ব্যয় করে একটি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস প্লান্ট করবে চীন।
চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় রাখাইন রাজ্যের তেল ও গ্যাস ক্ষেত্র থেকে চীনের ইউনান প্রদেশে একটি জ্বালানি করিডোর স্থাপনের পরিকল্পনা আছে।
বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বিবিসি বাংলাকে বলেন, "আমেরিকার সাথে চীনের যদি কোন সংঘাত হয়, তাহলে তারা মালাক্কা প্রণালী বন্ধ করে দেবে। এটা চীন জানে। তখন তারা তেল ও গ্যাসের সরবরাহ কোথায় পাবে?"
"চীন প্রচুর তেল-গ্যাস আমদানি করে। সেটা মিয়ানমার দিচ্ছে আকিয়াব বন্দরের মাধ্যমে। পাইপলাইনের মাধ্যমে চীন তেল-গ্যাস নিতে পারছে। "
এসব কারণে মিয়ানমারের প্রতি চীনের সমর্থন এবং সহানুভূতি আছে বলে মি. কবির উল্লেখ করেন।
আসিয়ান জোট ও জাপানের সমর্থন
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আসিয়ান জোট মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শক্ত কোন অবস্থান নেয়নি। সেটিরও বড় কারণ ব্যবসায়িক বলে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এই অঞ্চলে সবচেয়ে কার্যকরী অর্থনৈতিক জোট হচ্ছে আসিয়ান।
আসিয়ানের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর মিয়ানমারে শীর্ষ বিনিয়োগকারী। তাদের অনুমোদিত বিনিয়োগরে পরিমাণ প্রায় ২৪০০ কোটি ডলার। অর্থাৎ মিয়ানমারে যত বিদেশি বিনিয়োগ আছে তার এক-চতুর্থাংশ হচ্ছে সিঙ্গাপুরের।
এছাড়া জাপান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং দক্ষিণ কোরিয়া থেকেও বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে বলে মিয়ানমার সরকারের বরাত দিয়ে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। যদিও সামরিক জান্তা ক্ষমতা নেবার পর বিদেশি বিনিয়োগ সার্বিকভাবে কমেছে।
রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, মিয়ানমারের প্রতি জাপানেরও এক ধরনের সমর্থন আছে।
রাশিয়া সমর্থন দিয়েই যাচ্ছে
জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ টমাস এন্ড্রুস সম্প্রতি বলেছেন, চীন এবং রাশিয়া মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছে।
সাবেক মার্কিন কংগ্রেসম্যান টমাস এন্ড্রুস সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলেছেন, চীন এবং রাশিয়ার পাশাপাশি সার্বিয়াও মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে অস্ত্র দিচ্ছে, যদিও তারা জানে যে এসব অস্ত্র বেসামরিক মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে।
মিয়ানমারে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার আহবান জানিয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গত বছর একটি প্রস্তাব পাশ হয়েছে।
চীন এবং রাশিয়া এ প্রস্তাবে ভোট দান থেকে বিরত ছিল।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের একজন শীর্ষ কূটনীতিক জোসেপ বোরেল বলেছেন, মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে সেগুলো চীন এবং রাশিয়ার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন নিয়ে বিভিন্ন দেশ যখন ব্যাপক সরব ছিল তখন মিয়ানমারকে নিয়ে চীন এবং রাশিয়া কোন উচ্চবাচ্য করেনি। বরং মিয়ানমারের সাথে এ দুটি দেশ বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তারা কখনো মিয়ানমারের নিন্দা করেনি।
রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, মিয়ানমারের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তৈরি হয়েছে। এর বড় কারণ হচ্ছে রাশিয়া মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রি করছে।
ভারতের স্বার্থ কোথায়?
ভারতের সাথে মিয়ানমারের প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার স্থল সীমান্ত আছে। এছাড়া বঙ্গোবসাগরেও উভয় দেশের সীমান্ত রয়েছে।
ভারত ও মিয়ানমার ১৯৫১ সালে একটি মৈত্রী চুক্তি করেছিল। রোহিঙ্গাদের উপর ব্যাপক নিপীড়ন হলেও ভারত কড়াভাবে সেটির নিন্দা করতে পারেনি।
মিয়ানমারে বিভিন্ন সময় দমন-পীড়ন নিয়ে ভারত উদ্বেগ জানালেও তারা শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি।
ছিল।
জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ, হোটেল, তথ্য প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছিল পশ্চিমা কোম্পানিগুলো। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল মিয়ানমারে ব্যাপকভাবে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। দেশটির মোট জিডিপির ছয় শতাংশ হয়েছিল বিদেশি বিনিয়োগ।
ইউরোপিয়ান কমিশনের ওয়েবসাইটে ২০২১ সালে দেয়া তথ্যে বলা হয়েছে চীন, থাইল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুরের পরে মিয়ানমারের চতুর্থ ব্যবসায়ী-অংশীদার ইউরোপীয় ইউনিয়ন। উভয় পক্ষের মধ্যে বছরে ২৫০ কোটি ডলারের বেশি বাণিজ্য হয়।
সামরিক শাসন প্রত্যাহারের পর নরওয়ের টেলিনরও বিনিয়োগ করেছিল। যদিও ২০২১ সালে সামরিক শাসন পুনরায় ফিরে আসার পরে টেলিনর তাদের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি লেবাননের একটি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে মিয়ানমার ত্যাগ করে।
মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় আয় আসে তেল গ্যাস বিক্রি থেকে। তাদের রাজস্ব আয়ের অর্ধেক আসে এই খাত থেকে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মিয়ানমারের বিক্ষোভকারীরা দেশটির তেল-গ্যাস ফান্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা দেবার দাবি তুলেছিলে। কিন্তু পশ্চিমা কোম্পানিগুলো এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন হয়তো চাইলে মিয়ানমারের উপর বাণিজ্যিক অবরোধ দিতে পারে। কিন্তু সেটা তারা দিচ্ছে না।
"আমার ধারণা এটা তারা দিচ্ছে না কারণ এটা দিলে সাধারণ মানুষ বেকায়দায় পড়বে," বলেন মি.কবির।
সুত্র; বিবিসি বাংলা