মেজর জেনারেল (অব.) আ. ল. ম ফজলুর রহমান::
রোহিঙ্গা সমস্যা নতুন নয়। এ নিয়ে অনেক গুনিজন অনেক লেখালেখি ইতিমধ্যেই করেছেন। অনেক আলোচনা দেশে বিদেশের বিভিন্ন ফোরামে হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু কেন এই সমস্যা? কেন এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না? এর অন্তর্নিহিত কারণ আমাদের অনেকেরই হয়তো জানা, তারপরও আমি মনে করি এই সমস্যা নিয়ে আরও বেশি বেশি এবং গভীর আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের স্বার্থে এই রোহিঙ্গা সমস্যার মূলে পৌঁছে এর সমাধানের পথ বের করা অতীব জরুরী বলে কেন মনে করছি, এ লেখায় তাই-ই বলব।
আমরা যদি একটু গভীরভাবে খেয়াল করি, তাহলে দেখব বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জিও স্ট্রাটেজিক অবস্হানের মধ্যে একটা সাযূজ্য বা মিল আছে। পাকিস্তানের দক্ষিণে আরব ও ভারত মহাসাগর । বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। পাকিস্তানের পশ্চিমে শতভাগ মুসলমান অধ্যুষিত আফগানিস্তান। বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে রোহিঙ্গা মুসলমান অধ্যুষিত মিয়ানমার।
আমরা জানি বর্তমানে ভারত ও চীনের মধ্যে একটি বৈশ্বিক টানাপোড়েন এবং টানাহেঁচড়া চলছে। ডোকলামে সৈন্য প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে আমি ভারতের এক ধরণের পরাজয় অবলোকন করলাম। এর জের এবং চীন ভারতের টানাপোড়েনের সেন্টার অব গ্রাভেটি যে অন্য কোথাও শিফট করবে সেটা মোটামুটি নিশ্চিত ছিল বৈকি।
সে বিষয়ে আলোচনার আগে আমরা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কিছু আলোকপাত করতে চাই। অনেক বছর মিয়ানমার সামরিক শাসনে ছিল। মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর সরাসরি অংশগ্রহণ সেদেশের সংসদে এখনও আছে। অং সান সু চি’র সরকারের পক্ষে সংবিধানে এই মুহূর্তে পরিবর্তন এনে সামরিক বাহিনীর প্রভাব কমানো সম্ভব নয়।
বরং সামরিক বাহিনী নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সূ চি সরকারকে অকার্যকর প্রমাণ করে পুনরায় পুরোমাত্রায় ক্ষমতায় ফিরে আসতে। এটা করতে গিয়ে সামরিক বাহিনী চালের গুটি হিসাবে ব্যবহার করছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের।
কারণে অকারণে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপরে হত্যা এবং নির্যাতন চালিয়ে তাদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে। যাতে বাংলাদেশের সাথে একটি বৈরী ভাব অব্যাহত রেখে অভ্যন্তরীণ ভাবে মিয়ানমারের রাজনীতিতে সেদেশের সেনাবাহিনীকে অপরিহার্য ভাবে প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ করে রাখা সম্ভব হয়।
আমার ধারণা এবং আমি এটা মনেও করি যে, আন্তর্জাতিক ভাবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী চায় রোহিঙ্গা সমস্যার জঙ্গিকরণ হোক।
রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশনকে হয়তোবা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় বিদেশী কোনো শক্তি মদদ দিচ্ছে অর্থ এবং অস্ত্র দিয়ে, যাতে তারা দেশের ভিতরে সীমিত আকারে সেনাবাহিনী ও সীমান্ত পুলিশের উপরে আক্রমন করে একটি অস্হিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে সমস্ত রোহিঙ্গা সমস্যার জঙ্গিকরণ করে তাতে মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশকে টেনে এনে উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে আর একটি আফগানিস্তান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। এতে ভারত কৌশলগতভাবে ভাল লাভবান হবে। কারণ-
০১. অস্হিতিশীল মিয়ানমার চীনের জন্য আর এক আফগানিস্তান হয়ে আবির্ভূত হবে।
০২. রোহিঙ্গা সমস্যাকে জঙ্গী সমস্যায় পরিগণিত করে বাংলাদেশকে জড়িত করতে পারলে বাংলাদেশের অবস্থান হবে আফগানিস্তানের পাশে পাকিস্তানের মতো। পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও জঙ্গীবাদের উত্থান হবে। ফলে চীনের সাথে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপের ধারনা অংকুরে বিনষ্ট হয়ে যাবে। এটা হলে বাংলাদেশের মিডিল কিংডম হওয়ার ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে।
এখন দেখা দরকার এই অবস্থায় বাংলাদেশের করণীয় কী? বাংলাদেশের প্রথম করণীয় হলো-
০১. অতি সত্বর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি কার্যকরী এনগেজমেন্টে গিয়ে আরাকানে যাতে কোনোভাবে জঙ্গীবাদের উত্থান না ঘটে সে বিষয়ে একসাথে ও যৌথ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
০২. সরকারি পর্যায়ে মিয়ানমারের সাথে জঙ্গীবাদের উত্থান নিরসন কল্পে বাংলাদেশের করণীয় হলো জরুরিভাবে একটি চুক্তিতে উপনিত হওয়া।
০৩. একই সাথে রোহিঙ্গা মুসলমানরা আরাকানে তাদের ঘরবাড়িতে ফিরে গিয়ে যাতে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন সাধন করতে পারে তার জন্য মিয়ানমার সরকারের সাথে কার্যকরী এনগেজমেন্টে নিয়োজিত হওয়া বাংলাদেশের জন্য জরুরি।
আমরা এই অঞ্চলে শান্তি চাই। এই মুহূর্তে যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। শান্তির সোপানে আরোহনের সব কৌশলগত পদক্ষেপ বাংলাদেশ সরকার ও সামরিক বাহিনীকে যৌথভাবে দ্রুততার সাথে গ্রহণ করতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিয়ানমার সরকার ও সেদেশের সামরিক বাহিনীর সাথে কার্যকরী ভাবে এনগেজ হওয়াটা আবশ্যক বলেই অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে।
দুই.
বাংলাদেশের মিয়ানমারের সাথে এই মুহূর্তে যুদ্ধে জড়ানো কোনোভাবেই উচিৎ হবে না। মিয়ানমার চাইছে বাংলাদেশ যুদ্ধে জড়াক। মিয়ানমার বাংলাদেশের সাথে যুদ্ধ চায়। কারণ-
০১. বিশ্বের দৃষ্টি রোহিঙ্গা সমস্যা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে যুদ্ধের ডামাডোলে বাকি রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের ভিতরে ঠেলে দেওয়া সম্ভব হওয়ার একটা সুযোগ তৈরী হবে।
০২. যুদ্ধের দ্বারা বাংলাদেশকে দুর্বল করতে পারলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গাদের জন্য কোনোকিছু করা সম্ভব হবে না।
ইতিমধ্যেই চীন রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ে মিয়ানমারের পক্ষে জাতিসংঘ রেজ্যুলেশনে ভেটো দিয়েছে। এটাকে আমি ইতিবাচক হিসাবে দেখি। চীনের এই ভেটোর মাধ্যমে যা প্রতীয়মান হয় তা হলো চীন আমেরিকা এবং ভারতকে মিয়ানমারে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত রাখতে চায়। এর উদ্দেশ্য সম্ভবত চীন ভারতের বিরুদ্ধে মিয়ানমার এবং বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করে তার রোড বেল্ট পলিসি বাস্তবায়িত করতে চায়।
এটা ভুললে চলবে না বাংলাদেশে চীনের ২৪ বিলিয়নের বিনিয়োগ আছে। বাংলাদেশ চীনের ষ্ট্রাটেজিক পার্টনার। এই ডিপ্লোমেটিক অ্যাডভান্টেজকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের উচিৎ হলো-
০১. অনতিবিলম্বে চীনের সাথে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করা।
০২. চীনকে মিয়ানমারের বিপক্ষে চাপ হিসাবে ব্যবহার করে রোহিঙ্গা সমস্যার একটি ইতিবাচক সমাধান বের করা।
০৩. রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশে আসতে দেওয়া। এই উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের সামরিক প্রশিক্ষণ, অস্ত্র এবং সামরিক সহায়তা দিয়ে রাখাইন প্রদেশ স্বাধীন করতে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহন করা।
আমাদের বিশেষভাবে মনে রাখা জরুরি যে, রোহিঙ্গা সমস্যার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। এই সমস্যা এখন বাংলাদেশের জন্য মরণ ফাঁদ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। যদি ধরে নেই যে বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে গেল এক্ষেত্রে বিদেশী কোনো দেশ সামরিক শক্তি নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়াবে এমন মনে হয় না।
অতএব চীনমুখী কূটনৈতিক পদক্ষেপকেই আমি এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য অবশ্য করণীয় বলে মনে করি। তবে একই সাথে মিয়ানমারের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় সমর প্রস্তুতি থাকার কোন বিকল্প নাই। মিয়ানমারের বিপক্ষে সীমান্তে আগ্রাসী তৎপরতা বজায় রাখা যাতে মিয়ানমার সংযত হতে বাধ্য হয়।
মেজর জেনারেল আ. ল. ম ফজলুর রহমান: সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ রাইফেলস-বিডিআর(বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি)।