আন্তর্জাতিক ডেস্ক : মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের বিষয়ে প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)।
বিবিসি জানিয়েছে, নেদারল্যান্ডসের দি হেগের এ আদালতের কৌঁসুলি ফাতু বেনসুডা মঙ্গলবার এ তথ্য জানিয়ে বলেছেন, তার হাতে যে সব প্রমাণাদি রয়েছে তার ভিত্তিতে তিনি তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তিনি বলেন, লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে যেভাবে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে বিতাড়িত করা হয়েছে,তাতে যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না-সে বিষয়ে প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছে তার দপ্তর।
রোহিঙ্গাদের বিতাড়নে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য মিয়ানমারের বিচারের এখতিয়ার হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রয়েছে বলে সিদ্ধান্ত আসার ধারাবাহিকতায় এই তদন্ত শুরু হল।
আইসিসির এ তদন্তের পথ ধরে রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মিয়ানমারবাহিনীর দমন অভিযানের পূর্ণাঙ্গ তদন্তের পথ খুলতে পারে।
এর আগে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার এখতিয়ার আইসিসি’র রয়েছে বলে দি হেগের আদালত যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তা প্রত্যাখ্যান করে মিয়ানমার সরকার।
মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টের কার্যালয় আইসিসি’র সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে এক বিবৃতিতে বলে, ‘এই আদেশ ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়া ও সন্দেহজনক আইনি কার্যক্রমের ফল। মিয়ানমার আইসিসির এই আদেশকে শ্রদ্ধা দেখাতে কোনোভাবেই বাধ্য নয়।’
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এমন সব অভিযোগ আনা হয়েছে যা ব্যক্তিগত ট্র্যাজিডির বর্ণনা থেকে সংগৃহিত, যার সাথে আইনি যুক্তিতর্কের কোনো লেনাদেনা নেই। মূলত আদালতের ওপর আবেগীয় চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।’
এদিকে রাখাইনে মিয়ানমারবাহিনীর হত্যা-নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সেদেশের সেনাপ্রধানসহ জ্যেষ্ঠ ছয় জেনারেলকে বিচারের মুখোমুখি করার কথা বলা হয়েছে জাতিসংঘের স্বাধীন আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের রিপোর্টে।
মঙ্গলবার জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে উপস্থাপন করে একথা বলা হয়। ক্ষমতাধর জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের অপসারণ করা উচিত বলেও উল্লেখ করেছেন জাতিসংঘের তদন্তকারীরা।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৫ অগাস্ট রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকটি চেকপোস্টে ‘বিদ্রোহীদের’ হামলার অভিযোগ করে সেখানে অভিযান শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে ভয়াবহ নির্যাতন, খুন, বাড়ি-ঘরে আগুন, নারীদের ধর্ষণসহ বর্বর অত্যাচার শুরু করে তারা। এ অবস্থায় প্রাণে বাঁচতে পালাতে শুরু করে রোহিঙ্গারা এবং সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করে।
পর্যায়ক্রমে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজারে এসে আশ্রয় নিয়েছে। রাখাইনে মিয়ানমারবাহিনীর নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভয়াবহ বিবরণ তুলে ধরে তারা।
এদিকে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা মিয়ানমারবাহিনীর ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। অভিযোগ অস্বীকার করে মিয়ানমার সরকার বলে আসছে, তাদের ওই অবিযান ‘সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে, কোনো জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করার জন্য নয়।
তবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সরকারের ওই দাবি নাকচ করে দিয়ে কিন্তুনজাতিসংঘের গঠিত আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন বলছে, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের যে ধরনের অপরাধ হয়েছে, সেসবের মাত্রা, ধরন এবং বিস্তৃতির দিক দিয়ে তা ‘গণহত্যার অভিপ্রায়কে’ অন্য কিছু হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টার সমতুল্য।
ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন আরো বলেছে, রাখাইনে নির্যাতন-হত্যাযজ্ঞের হোতাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা অস্থায়ী একটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্যে দিয়ে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। আর এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে।
তবে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সদস্য না হওয়ায় সেখানে সংঘটিত অপরাধের বিচার করার সরাসরি কোনো এখতিয়ার এ আদালতের নেই।
কিন্তু রোহিঙ্গারা যেহেতু মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে, এভাবে তাদের বিতাড়নের বিষয়টি যেহেতু আন্তঃসীমান্ত অপরাধের পর্যায়ে পড়ে এবং বাংলাদেশ যেহেতু আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সদস্য, সেহেতু আইসিসি বিষয়টি তদন্ত ও বিচার করতে পারে কি না- সেই প্রশ্ন রেখে গত এপ্রিলে একটি আবেদন করেন ওই আদালতের প্রসিকিউটর ফাতু বেনসুদা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য এবং বিভিন্ন অধিকার সংগঠনের যুক্তি শুনে আইসিসির তিন বিচারকের প্রি ট্রায়াল প্যানেল গত ৬ সেপ্টেম্বর সিদ্ধান্ত দেয়- এ বিষয়টি বিচারের এখতিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রয়েছে।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য মিয়ানমারের বিচার করার এখতিয়ার আইসিসি’র রয়েছে বলে দেওয়া সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের কয়েকজন এমপি। আসিয়ান পার্লামেন্টারিয়ান ফর হিউম্যান রাইটসের (এপিএইচআর) সভাপতি ও মালয়েশিয়ার এমপি চার্লস সান্তিয়াগো বলেছেন, ‘এটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়নের অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে উঠেছে তাদের দোষী সাব্যস্ত করতে এটি অগ্রগামী পদক্ষেপ।’
এপিএইচআরের বোর্ড সদস্য ও ইন্দোনেশিয়ার এমপি ইভা কুসুমা সুন্দরি বলেছেন, ‘আইসিসি এখন তদন্তের সুযোগ পেয়েছে। এর মানে হচ্ছে যাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিচার এবং একটি জাতিগোষ্ঠীর ওপর দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা নিপীড়ন ও অবিচারের সমাপ্তি টানার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।’