বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের অপরাধের মাত্রা বেড়েই চলছে। খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, চাঁদাবাজি, মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েছেন তারা। এমনকি ভুয়া নাগরিকত্ব গ্রহণ এবং নানা উপায়ে পাসপোর্ট করে বিদেশে যাওয়ার মতো অপরাধের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট রোহিঙ্গারা।
এছাড়া আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) ও আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশনসহ (আরএসও) ১০-১৫টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনী কার্যক্রম পরিচালনা করছে উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয়। ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন থানায় রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নানা অপরাধে সাড়ে তিন হাজারের মতো মামলা হয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছর পাঁচ মাসে ক্যাম্পগুলোয় ২৫টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।
স্থানীয়রা বলছেন, দিন যত যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের বেপরোয়া মনোভাব ও অপরাধ কর্মকাণ্ড ততই বেড়ে যাচ্ছে। এতে কক্সবাজারের স্থানীয় অধিবাসীরা সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে রয়েছেন। এর মধ্যে সীমান্তের ওপারে গোলাগুলির কারণে বাংলাদেশের টেকনাফ সীমান্ত অতিক্রম করে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে রোহিঙ্গারা। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সম্প্রতি চীন-জাপানসহ পশ্চিমা বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী-এমপিরা।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামরিক জান্তার অভিযান শুরু হলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামতে শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তী পাঁচ মাসে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। অন্যদিকে আগে থেকেই প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ছিল। বর্তমানে পুরোনো ও নতুন মিলিয়ে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখের বেশি।
তথ্যে দেখা যায়, ১০ জুন ভোরে কক্সবাজারের উখিয়ার মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরে দুর্বৃত্তদের হামলা ও গুলিতে তিন রোহিঙ্গা নিহত হন। ১৯ মে উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) চার সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে বেশকিছু হ্যান্ড গ্রেনেড, ওয়াকিটকি, অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়। ২৩ মে কক্সবাজারে উখিয়া উপজেলার আশ্রয়শিবির থেকে আবদুল্লাহ আরসার এক শীর্ষ কমান্ডার গ্রেফতার করে পুলিশ। তার কাছ থেকে দুটি পিস্তল ও দুটি গুলি উদ্ধার করে। তার বিরুদ্ধে আটটি হত্যাসহ নানা অভিযোগে মামলা রয়েছে। ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আরসা সন্ত্রাসীর গুলিতে খুন হন রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ। তিনি আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন।
সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ২০১৭ সালে যখন প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে সহিংসতা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের মানুষ তাদের মমতা দিয়ে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ক্রমেই রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন স্থানে কর্মসংস্থান করছে আর ক্যাম্পগুলো মানুষ পাচার, মাদক চোরাচালান, জঙ্গি নিয়োগসহ নানা অপরাধের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। ফলে স্থানীয়দের জীবন অতিষ্ঠপ্রায়। তিনি দেশে আশ্রিত প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গার নিজ দেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন, সে দেশের রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাত নিরসন ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে জাতিসংঘের সংস্থাগুলো এবং অন্য অংশীদারদের সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে জোর আহ্বান জানান।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, রোহিঙ্গা নাগরিকরা মাদক, মানব পাচারসহ সংঘবদ্ধ অপরাধচক্রে জড়িয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, তাদের জন্য বিদেশি সহায়তা কমে যাওয়ায় বাংলাদেশকে কোটি কোটি ডলার ঋণ নিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, নতুন করে আর কোনো রোহিঙ্গাকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। একই সঙ্গে ক্যাম্পগুলোয় থাকা রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠতে শক্তিশালী উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘসহ পশ্চিমা বিশ্ব, চীন ও ভারতের পাশাপাশি আশিয়ানকে সর্বোচ্চ ভূমিকা নিতে হবে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার আরাফাত ইসলাম বলেছেন, অন্য বাহিনীগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে ক্যাম্পগুলোয় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে র্যাব। ইতোমধ্যে বেশকিছু অভিযানে অনেক অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অপরাধী যেই হোক, নিয়মিত অভিযান অব্যাহত থাকবে।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অপরাধের বিষয়ে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে এ বছর ৩১ মার্চ পর্যন্ত কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ থানায় বিভিন্ন অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ৩ হাজার ৩৩৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে উখিয়া থানায় ২ হাজার ৪০৭টি এবং টেকনাফ থানায় ৯২৯টি মামলা হয়। মোট মামলার ৬০ শতাংশের বেশি মাদক সংক্রান্ত। মাদকের ঘটনায় ২ হাজার ২১টি মামলা হয়েছে। অবৈধ অস্ত্র ও গুলির ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩৭৬টি, যা মোট মামলার ১১ শতাংশের বেশি। খুনের ঘটনা তৃতীয় অবস্থানে। চলতি বছর মার্চ পর্যন্ত খুনের ঘটনায় ২২০টি মামলা হয়েছে, যা মোট মামলার ৭ শতাংশের মতো। এছাড়া অপহরণের ঘটনায় ১০৪টি এবং মারামারিতে ১২৯টি মামলা হয়।
পুলিশের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৭ সালে আশ্রয়শিবিরগুলোয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৮ মামলায় আসামি ছিল ২২ জন। ২০১৮ সালে ১৫ হত্যা মামলায় আসামি ৩৩ জন, ২০১৯ সালে ২২ হত্যা মামলায় আসামি ১০৭ জন, ২০২০ সালে ১৩ হত্যা মামলায় আসামি ১২৩ জন, ২০২১ সালে ১৩ হত্যা মামলায় আসামি ৬৫ জন, ২০২২ সালে ২০ হত্যা মামলায় আসামি ২৩৭ জন এবং ২০২৩ সালের ২১ আগস্ট পর্যন্ত পৌনে আট মাসে ৪০টি হত্যা মামলায় আসামি ছিল ৪০৪ জন।
চলতি বছরের শুরুর দিকে পুলিশ সদর দপ্তরের এক তথ্যে জানা যায়, বিভিন্ন মামলায় ৮৭২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যেখানে কক্সবাজার জেলা থেকে ৮৫৮ এবং নোয়াখালী থেকে ১৪ জন। একই তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের শেষ পর্যন্ত ভাসানচর থানার আশ্রয়ণ প্রকল্প-৩-এ মামলা হয়েছে ১০টি, যেখানে ১৪ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। এছাড়া কক্সবাজারের উখিয়া থানাধীন ২৫টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় ৬২৮ জনকে এবং টেকনাফ থানাধীন ৮টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকার মামলায় ২৩০ জন রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করা হয়।
এদিকে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তথ্যে জানা গেছে, চলতি বছর গত পাঁচ মাসে একাধিক সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনায় অন্তত ২৬ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে জুনের প্রথম ১২ দিনেই উখিয়ার কয়েকটি আশ্রয়শিবিরে সংঘর্ষ, গোলাগুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে অন্তত ৯ জন খুন হন। এর মধ্যে সশস্ত্র গোষ্ঠী দুটির পাঁচজন সদস্যও রয়েছেন। তথ্যে দেখা যায়, গত মে মাসে ৭ রোহিঙ্গা খুন হন। এপ্রিলে ৪ জন। মার্চে খুনের ঘটনা ঘটেনি। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ৪ জন করে মোট ৮ জন খুন হন। এছাড়া ২০২৩ সালে খুন হয় ৬৪ জন। এসব ঘটনায় আরসার শীর্ষ নেতাসহ ১২৯ সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়।
বিজিবির তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকালে ৩ হাজার ৩৫৪ জন রোহিঙ্গা নাগরিককে আটক করেছে বাহিনীটি। পরে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়। তাদের মধ্যে ৮৪৮ জন নারী, ৭৪৯ শিশু ও ১৭৫৭ জন পুরুষ। আর তিন রোহিঙ্গাকে থানায় দেওয়া হয়।
এদিকে, কয়েকদিন ধরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মংডুতে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান যুদ্ধের তীব্রতা বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। রোহিঙ্গারা নতুন করে ঢুকতে শুরু করলে জটিলতা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (৮-এপিবিএন) অধিনায়ক অ্যাডিশনাল ডিআইজি মোহাম্মদ আমির জাফর যুগান্তরকে বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে যুদ্ধের কারণে মাঝেমধ্যে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করে। তবে সীমান্তে বিজিবি-কোস্ট গার্ডসহ অন্যান্য সংস্থা সমন্বিতভাবে কাজ করছে। সুত্র: যুগান্তর
পাঠকের মতামত