পাশের দেশ ভারতের স্রেফ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা। আর তাতেই যেন আগুন লেগেছে পেঁয়াজের বাজারে। সকালে এক দর তো রাতে অন্য রকম দামের ঘূর্ণি। গলির দোকানে কোথাও কোথাও দাম শিকড় থেকে ওঠে শিখরে। পাইকারি দামের নাটাইও যেন নেই কারও হাতে। সারাদেশের ব্যবসায়ীরা যে যেভাবে পেরেছে, গতকাল শনিবার অসহায় ক্রেতার পকেটে ছুরি চালিয়েছে। মসলাজাতীয় এ পণ্য কিনতে আদাজল খেয়ে নেমেছিলেন অনেক ক্রেতা। অপ্রয়োজনে কেউ কেউ করেছেন মজুত। কোথাও আবার বাজার থেকেই উধাও। আর তাতেই ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে কেজিতে ৯০ থেকে ১১০ টাকা বেড়ে এখন ২৫০ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে পেঁয়াজ।
দু’দিন ধরে পেঁয়াজ নিয়ে বাজারে এমন হরিলুট চললেও যেন দেখার কেউ নেই। কোথাও কোথাও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর মাঠে নামলেও কারসাজি যা করার, তা সেরে নিয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। গতকাল সরকারি এ সংস্থা সারাদেশে ১৩৩ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে।
এ পটভূমিতে বাজার নিয়ন্ত্রণে অন্য দেশ থেকে দ্রুত পেঁয়াজ আমদানির কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পারা। সে জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোকে এলসি দিতে হবে। তা না হলে দাম নিয়ন্ত্রণ কঠিন হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
এদিকে পেঁয়াজ বাজারের হুলস্থুলকাণ্ডে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসছে। মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে বলা হয়েছে, কীভাবে বিকল্প দেশ থেকে আমদানি বাড়ানো যায়, সে চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে টিসিবির মাধ্যমে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য পেঁয়াজ বিক্রি অব্যাহত থাকবে। যদিও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের দাবি, কৃষি মন্ত্রণালয় আমদানির অনুমতি দিতে দেরি করেছে। আরও আগে আমদানির ব্যবস্থা করলে এমন ঝক্কিতে পড়তে হতো না।
কেজি কত এখন
গত শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে দেশি পেঁয়াজের কেজি ১৩৬ থেকে ১৪০ এবং ভারতীয় পেঁয়াজের কেজি ১০৬ থেকে ১১০ টাকা বিক্রি হয়েছিল। ১১টার দিকে ভারত রপ্তানি বন্ধের খবর ছড়িয়ে পড়ার পরই বাজার অস্থির হতে শুরু করে। ব্যবসায়ীদের যার কাছে যে পরিমাণ পেঁয়াজ ছিল, তা নিয়েই তারা দাম বাড়ানোর অসম প্রতিযোগিতায় নামে। কেউ কেউ আরও বেশি দরে বিক্রির আশায় দোকান গুটিয়ে চলে যায়। তাতে এক পর্যায়ে ওই দিন সন্ধ্যায় দেশি ভালো মানের পেঁয়াজ ২০০ ও ভারতীয় পেঁয়াজ ১৬০ টাকায় বেচাকেনা হয়। তবে গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মালিবাগ, হাতিরপুল, মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেট ঘুরে জানা গেছে, দাম আরও বেড়ে খুচরা পর্যায়ে দেশি পেঁয়াজ ২৪০ থেকে ২৫০ এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ১৮০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া বড় আকারের চায়না পেঁয়াজ কেজিতে সর্বোচ্চ ৬০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়। অর্থাৎ এক দিনের ব্যবধানে তিন ধরনের পেঁয়াজের কেজিতে বাড়ে ৬০ থেকে ১১০ টাকা। তবে অন্য ছোট বাজারের চেয়ে কারওয়ান বাজারে সব ধরনের পেঁয়াজ অন্তত ১০ থেকে ২০ টাকা কম দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। পাশাপাশি বেশির ভাগ দোকানে গত দুই দিনের তুলনায় পণ্যটির সরবরাহ কম দেখা গেছে।
এদিকে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে গতকাল দুপুরের পর বেশির ভাগ মোকাম থেকে পেঁয়াজ উধাও হয়ে যায়। অনেক আড়তে দেখা যায়, আদা-রসুন থাকলেও পেঁয়াজ নেই।
‘ডাকাতি’ করছে ব্যবসায়ীরা
এভাবে দ্রুত দাম বাড়ার কারণে ২০১৯ সালের রেকর্ড দামের ভয় তাড়া করছে ক্রেতাদের। ক্ষোভ প্রকাশ করে ক্রেতারা বলছেন, রাতারাতি দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বিশ্বের কোনো দেশে এমন ঘটনা বিরল। রীতিমতো ভোক্তার ‘পকেট কাটছে’ ব্যবসায়ীরা। বিকল্প দেশ থেকে আমদানি করে এখনই এ অসাধু তৎপরতা থামানো উচিত।
গতকাল রাজধানীর হাতিরপুলে আবদুল হালিম নামের এক ক্রেতা বলেন, ‘গতকাল টিভিতে দেখলাম ভারত রপ্তানি বন্ধ করেছে। আজ ১৯০ টাকা দাম হয়ে গেছে। অথচ দুই দিন আগেও ভারতীয় পেঁয়াজ ১১০ টাকায় কিনেছি। রীতিমতো ডাকাতি করছে ব্যবসায়ীরা। সরকারের এদিকে কোনো খেয়াল নেই।’
কারওয়ান বাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী আবদুল হান্নান বলেন, ভারত রপ্তানি বন্ধের খবরে দাম বাড়িয়েছেন কৃষকও। মোকামে (উৎপাদন এলাকার পাইকারি বাজার) পেঁয়াজের সরবরাহ কমে গেছে। মোকামেই দেশি পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে প্রায় ২০০ টাকায়। এর সঙ্গে পরিবহনসহ অন্য খরচ তো আছেই। মূলত পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়ার কারণে খুচরায় বেড়েছে বলে তিনি জানান।
আমদানি না হলে কঠিন হবে নিয়ন্ত্রণ
ভারতের ডিরেক্টর জেনারেল অব ফরেন ট্রেড (ডিজিএফটি) গত বৃহস্পতিবার দেশটির অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। গত ২৯ অক্টোবর ভারত প্রতি টন পেঁয়াজ রপ্তানি মূল্য ৮০০ ডলার নির্ধারণ করে দেয়, যা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলা হয়েছিল। তবে ৩১ ডিসেম্বরের আগে এখন একেবারে রপ্তানি বন্ধই করে দিয়েছে দেশটি।
হিলি স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন উর রশিদ বলেন, ‘যেসব পেঁয়াজের এলসি করা ছিল, সেগুলোও দিচ্ছে না ভারতের ব্যবসায়ীরা। অন্য দেশ থেকে আনা যাবে। আনতে হবে জাহাজে। আর জাহাজে আনতে গেলে এক-দুই কনটেইনার এনে পোষাবে না। আনাও যাবে না। আনতে হবে জাহাজভর্তি। বেশি পেঁয়াজ আনতে হলে ৫ থেকে ১০ লাখ ডলারের এলসি নিতে হবে। কিন্তু ব্যাংক ২০-২৫ হাজার ডলারের বেশি এলসি দিতে চায় না। এটাই বড় সমস্যা।’ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিত্যপণ্যের এলসির পরিমাণ বাড়ানোর অনুরোধ করে তিনি বলেন, ‘পেঁয়াজের মতো নিত্যপণ্যের এলসি দিচ্ছে না ব্যাংক। অথচ বিলাসবহুল পণ্য আমদানি হচ্ছে।’
ভোক্তা অধিদপ্তর দুষছে কৃষি মন্ত্রণালয়কে
কিছুটা দেরিতে আমদানির অনুমতি দেওয়ায় এখন বিপদ হচ্ছে বলে মনে করেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকেই গত মে মাসে বলা হয়েছিল, ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দিতে পারে। তাতে এবার পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হবে। সে জন্য আমদানির অনুমতি দিতে কৃষি মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হয়। তখন আমদানির উদ্যোগ নিলে দেশে এতদিনে প্রচুর পেঁয়াজ আসত। এ পরিস্থিতিও তৈরি হতো না।’
তিনি বলেন, ‘শুক্রবার দাম বাড়ার পরই গতকাল সারাদেশে অভিযান চালানো হয়েছে। ১৩৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু আমদানি বন্ধ থাকলে এ অভিযান করে বাজার কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘ভারতের রপ্তানি বন্ধের সুযোগটা নিয়েছে ব্যবসায়ীরা। এটা ঠিক হয়নি। তবে ভোক্তা অধিদপ্তর বাজার নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘বছরের এ সময়টা সাধারণত ভারতের পেঁয়াজ দিয়ে চাহিদা মেটানো হয়। কিন্তু এমন সময়েই ভারত রপ্তানিটা বন্ধ করে দিল। এখন অন্য দেশ থেকে কীভাবে আমদানি করা যায়, সে চেষ্টা চলছে। তবে গরিব মানুষের জন্য টিসিবির মাধ্যমে বিক্রি অব্যাহত থাকবে।
এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ জুন থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৯ লাখ ৯৩ হাজার ২৯১ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আমদানি হয়েছে ৭ লাখ ৫ হাজার ৪৩৭ টন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, এখন গ্রীষ্মকালীন কিছু পেঁয়াজ আসছে বাজারে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে ফলন কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মূল পেঁয়াজ আসতে কিছুটা সময় লাগবে।
এদিকে সাম্প্রতিক বৃষ্টির কারণে পাবনার সাঁথিয়ার কৃষকদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। তাদের শঙ্কা, এ বছর পেঁয়াজ আবাদ দেরি হতে পারে। এতে তাদের আর্থিক ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে। উপজেলা কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, দেশের মোট উৎপাদনের ১০ শতাংশ পেঁয়াজ সাঁথিয়াতে উৎপাদিত হয়। সেখানে চলতি মৌসুমে ১৭ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে ১ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে মূলকাটা (কন্দ) পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে। বাকি ১৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে হালি বা চারা পদ্ধতির পেঁয়াজের আবাদ হবে।
এদিকে, ভারত থেকে পেঁয়াজ আসা বন্ধের খবরে সাঁথিয়ায় গতকাল প্রতি মণ পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকায়, যা গত শুক্রবার ছিল ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা।