ডিভোর্স শব্দটি নিয়ে আমাদের সমাজে যে এত আপত্তি, সেটার পেছনে একটা অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে মুরুব্বিরা মনে করেন ডিভোর্সি হলেই জীবন নষ্ট। একজন মানুষের, বিশেষ করে একটি মেয়ের ডিভোর্স হয়েছে মানে তাঁরা আর কখনো সুখী হবেন না দাম্পত্য জীবনে। তাঁদের আর ভালো বিয়ে হবে না, হলেও সেই বিবাহিত জীবনে অশান্তি হবে ইত্যাদি ১০০ রকমের ভ্রান্ত ধারণা আমাদের সমাজের মানুষের মনে। আর সেই ধারণা গুলো যে একেবারেই ভিত্তিহীন, সেটা প্রমাণ করে দিয়েছেন আমাদের আজকের লাভ ডায়েরির এই মিষ্টি দম্পতি। আমাদের আজকের ভালোবাসার গল্পটি শাফায়াত-ই-শাফিয়া ও মোঃ তারিকুল ইসলামের। যারা দুনিয়াকে দেখিয়ে দিয়েছেন যে সুখী হতে কেবল প্রয়োজন স্বদিচ্ছা ও সাহসের!
গল্পটি শুরু হয় ২০১৪ সালে, যখন কিনা শাফিয়া ব্যক্তিগত জীবনে এতটাই হতাশ হয়ে পড়েছিলেন যে বেছে নিতে চেয়েছিলেন আত্মহত্যার পথ। মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল এই মেয়েটির, সাত সাতটি বছর শত গঞ্জনা-বঞ্চনা সয়ে শেষ পর্যন্ত যখন অর্থহীন সেই বিয়েতে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিলেন, পাশে ছিল না কেউই। না, এমনকি নিজের পরিবারও নয়। পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করে শাফিয়ে বলেন, " বিয়ে ভাঙায় আমার পরিবারের মত না থাকায় তারা কোন ধরনের সহায়তাই করেনি। নিজের খরচ নিজে চালিয়েছি টিউশনি, ইভেন্ট, ফেয়ার আর পার্টটাইম জব করে। প্রথম ধাক্কাটা মাথা উঁচু করে নিলেও ২য় টা আর নিতে পারিনি, ভালোবেসে ফেলেছিলাম এক মেরুদণ্ডহীনকে। সব কিছু জেনেও যে আমার সাথে সম্পর্কে জড়ায় কিন্তু বিয়ের কথা বললেই ফ্যামিলির দোহাই দিয়ে কেটে পড়ে। আজ খুব সহজেই কথাগুলো বলে ফেলছি.... কিন্তু একটা টিনেজারের জন্য ব্যাপারগুলোন মৃত্যুর মতোন ছিলো! নিজের পরিবারের অবহেলা আর বাইরের মানুষের কুতসিত রূপ দেখে বাঁচার ইচ্ছেটা মরে গিয়েছিলো। কিন্তু আমার বেস্ট ফ্রেন্ডটার কারণে ওই যাত্রা বেঁচে যাই। আল্লাহ্ আমাকে এক নতুন জীবন দান করেন যেখানে আনন্দ আর সুখ ভরপুর রাজত্ব করে...."
গল্পের শুরু ঠিক এখান থেকেই। মানসিকভাবে প্রচণ্ড বিধ্বস্ত অবস্থায় শাফিয়ার ফেসবুক আইডির নাম ছিলো 'অতৃপ্ত আত্মা"। সেটা দেখে তারিকুল সাহেবের হয় প্রচণ্ড আগ্রহ। ফটোগ্রাফি পেজের সূত্র ধরে শাফিয়া মেসেজ পাঠান তিনি। শাফিয়া জানান, " তখনো বুঝিনি এই টেক্সট আর টেক্সট এর মানুষটা আমার জীবনের ফেরেশতা। এরপর আবার ২০১৪ এর ১৮ নভেম্বর ভোরে উনি আমাকে টেক্সট করেন। ফ্রি সময় থাকায় এবং লোকটির ভদ্রতা জ্ঞান এ আকৃষ্ট হয়ে রিপ্লাই দিতে থাকলাম। দুপুরের দিকে অতি ভদ্রতার সাথে উনি আমাকে কফির জন্য ইনভাইট করেন। কী ভেবে আমিও হুট করে হ্যাঁ বলে ফেলি। কথায় কথায় জানতে পারি উনিও ডিভোর্সি। দেখা যখন হলো দেখলাম উনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় হবেন। জানলাম উনি আমার চেয়ে ১২ বছরের বড়! এত্ত ম্যানারড পারসন আমি তার আগে দেখিনি। আমি মিডল ক্লাস এর মোটামুটি চলতে পারা ফ্যামিলির মেয়ে। বাট উনি সেল্ফ মেইড। ২৫ বা ২৮ এর খুব কম ছেলেরাই এত এক্টিভ থাকে! আড্ডা শেষে আমার সাবলেটের বাসায় ড্রপ করলেন। বুঝতে পারছিলাম উনি আমাকে বেশ পছন্দ করে ফেলেছেন। তাই দ্বিতীয় বার দেখা করতে চাইনি.... অনেক না বলার পরও উনি ঠিক ই বাসার নিচে এসে অপেক্ষা করেছেন আমার নামার জন্য। আমি একথায় ওকথায় স্পষ্ট বলে দেই যে আমি আর কোন রিলেশন নিয়ে আপাতত ভাবছি না। যা হোক, এভাবে কয়েকদিন বের হওয়ার পরই হঠাৎ উনি আমাকে বলে উঠলেন-আমাকে বিয়ে করবি?"
কিন্তু না, এই প্রস্তাবে কিন্তু কাজ হয়নি। শাফিয়া সোজা তারিকুল সাহেবকে জানিয়ে দিলেন যে বন্ধু ছাড়া আর কিচ্ছু ভাবে না তাঁকে। এরপর যখন আরেকদিন বিয়ের কথা বললেন, শাফিয়ার মাথায় খেলে যায় দুষ্টু বুদ্ধি। মানুষটির ভালোবাসার গভীরতা পরিমাপের জন্যই বলে বসেন- "আমি আমার বিয়ে নিয়ে কোন ডিসিশন নিবনা। আমার ফ্যামিলির কাছে প্রস্তাব পাঠান অফিসিয়ালি, তারা রাজি হলে আমি রাজি।" মজার ব্যাপারটা হচ্ছে, এই আপাত অসম্ভব শর্তেও রাজি হয়ে যান তারিকুল। এবং অদ্ভুত ভাবেই দুটি পরিবারকে রাজি করিয়ে ফেলেন বিয়েতে! তারিকুল সাহেবের বড় বোনের কাছে শাফিয়া জানতে পারে যে মানুষটির প্রাক্তন স্ত্রী ১০ বছরের প্রেম ও ১০ বছরের সংসার ফেলে অফিসের বসের সাথে পরকীয়া করে ডিভোর্স দিয়েছে। মানুষটির প্রতি মুগ্ধতা বাড়ে শাফিয়ার, বাড়ে মনের মাঝে তিল তিল করে গড়ে ওঠা সম্মানও।
এরপর ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি। নানান ঘাট প্রতিঘাত পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত এই টোনা-টুনির বিয়েটা হয়েই যায়! হানিমুন শেষে সোজা নিজেদের ফ্ল্যাটে নিজেদের মত সংসার গুছিয়ে নেয়া। তারিকুল সাহেব কেমন মানুষ এই প্রশ্নের জবাবে শাফিয়া হেসে বলেন," ওকে যতোই আবিষ্কার করি, ততোই অবাক হই! অফিসের সময় টুকুন বাদ দিলে এক পা ও নড়েনা আমাকে ছাড়া। অগত্যা কোত্থাও গেলে আমাকেও সাথে যেতে হয়। আমি গাড়িতে বসে থাকি, সে আড্ডা দেয়। আমার পরীক্ষার সময় আমি পড়তে বসলে সে বেনী ধরে টানতো, বলতো তার একা একা ভাল্লাগে না...
অনেক বলে কয়ে তাকে সন্ধ্যায় বাসার বাইরে পাঠাতাম আড্ডা দেয়ার জন্য যাতে আমি একটু পড়তে পারি! সকালে আমি আলসেমি করি বলে ব্রেকফাস্টটা সে নিজেই রেডি করে আমাকে টেবিলে ডাকে। আমি মাছ খাইনা, কিন্তু ওর মাছ খুব প্রিয়। শাশুড়ির আর ওর কাছ থেকে মাছ রান্না শিখেছি। আমার হাতের মাছ রান্না ওর খুব প্রিয়। এখন তো শুঁটকিও রাঁধি মাঝে মাঝেই! দুপুরে রোজ সে খেতে আসে। বলে তোমার হাতের রান্না মজার, আমার কি দোষ। আসলে আমি বিয়ের আগে একবার বলে ফেলছিলাম যে আমার একা একা খেতে ভালোলাগেনা, তাই রোজ কষ্ট করে টাইম বের করে সে আমার সাথে লাঞ্চ করতে আসে.... মানুষটা তার ভালোবাসা দিয়ে আমার মন জয় করেছে। ওকে দেখেই বুঝেছি, দুনিয়ায় ওর মতোন ভালো মানুষ আছে বলেই দুনিয়াটা টিকে আছে... অফিসে সে বস এর মদমেজাজী ভাব ধরে রাখলেও বাসায় সে লক্ষ্মী স্বামী যে বৌয়ের সব কাজে হেল্প করে! সবসময় চেষ্টা করে আমাকে রাগিয়ে দেয়ার, আমি রেগে গেলে সে খুব মজা পায়.... আমিও মিথ্যা মিথ্যা দেখাই যে আমি রেগে গেছি..."
এইরকম খুনসুটি করেই কাটছে শাফিয়া-তারিকুলের টোনাটুনির সংসার। প্রিয়.কমের তরফ থেকে রইলো এক আকাশ শুভকামনা তাঁদের জন্য।