তোফায়েল আহমদ, কক্সবাজার ::
টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র আঘাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির রেশ কাটতে না কাটতে টানা বর্ষণে বাসিন্দাদের দুর্ভোগ বহুগুণ বেড়ে গেছে। ২৯ মে মোরার তাণ্ডবে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয় এই দ্বীপে। সেই তাণ্ডবের একমাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেননি দ্বীপবাসী। লণ্ডভণ্ড বাড়ি-ঘর অর্থাভাবে সংস্কার করতে না পেরে পরের ঘরে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছেন অনেকে।
গত পাঁচ বছর ধরে ওই দ্বীপের বাসিন্দারা বেড়িবাঁধের ভাঙনের কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দীর্ঘদিনের ভাঙা বেড়িবাঁধে জোয়ারের পানি ঢুকে বহু ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি বিলীন হয়ে যায়। এমনিতে টানা পাঁচ বছরের বেশি সময় নানা দুর্ভোগ-দুর্দশা, এর ওপর ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র তাণ্ডব এবং গত সপ্তাহে কয়েক দিনের টানা বর্ষণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এ জনপদের মানুষের কাছে ‘মরার উপর খাড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শাহপরীর দ্বীপের মাঝেরপাড়ার বাসিন্দা সৈয়দ উল্লাহ বলেন, ‘বেড়িবাঁধ বিলীন হলে আমাদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি হারিয়ে ফেলি। পরের জমিতে কোনোমতে ঘর তৈরি করে বসবাস করে আসছি। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র তাণ্ডবে সেই ঘরটিও সম্পূর্ণ তছনছ হয়ে গেছে। এখন দূরসম্পর্কীয় এক আত্মীয়ের ঘরে আশ্রয় নিয়েছি। এরপর আমরা যাব কোথায়?’
জালিয়াপাড়ার বাসিন্দা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘গত বছর ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’তে বেড়িবাঁধের খোলা অংশে জোয়ারের পানির উচ্চতা বেড়ে ঘরবাড়ি তলিয়ে যায়। প্রায় দেড়মাস বাড়িঘর জোয়ারের পানিতে ভাসতে থাকে। সেই ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে ওঠতে না ওঠতে এ বছর ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়। ’
এলাকাবাসী জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’র আঘাতে তাঁদের কৃষিজমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেই দুর্যোগের পর লোকজন হালচাষে নামলে গত সপ্তাহের কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে ক্ষেতের সব বীজ পানিতে তলিয়ে গিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। এ রকম অবস্থায় অনেক কৃষক অভাব-অনটনে চরম অসহায় অবস্থায় দিন পার করছেন। শাহপরীর দ্বীপের বেশির ভাগ লোকের জীবিকা নির্বাহ হয় সাগরে মাছ ধরে। কিন্তু দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে সাগরেও তাঁরা যেতে পারছেন না। ’
এ প্রসঙ্গে দক্ষিণপাড়ার জেলে নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘গত মাসেও ঘূর্ণিঝড়ের আগে পরে খারাপ আবহাওয়ার কারণে অনেকদিন সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া হয়নি। এর পর কয়েকদিন টানা বর্ষণ এবং দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় কোনো জেলে ঝুঁকি নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যাচ্ছেন না। ফলে জেলে পরিবারে নীরব অভাব চলছে। ’
বেড়িবাঁধ ভেঙে শাহপরীর দ্বীপের যোগাযোগের প্রধান সড়কটিও জোয়ারের পানিতে বিলীন হয়ে যাওয়ায় প্রায় চার কিলোমিটার পথ নৌকায় পাড়ি দিতে হয় টেকনাফ যেতে। এতে দ্বীপের প্রায় ৫০ হাজার বাসিন্দার যাতায়াতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বিশেষ করে কলেজ শিক্ষার্থী, নারী, বৃদ্ধা ও রোগীর যাতায়াতের দৃশ্য হৃদয়বিদারক। তাঁরা এ ভোগান্তি থেকে দ্রুত পরিত্রাণ চান।
এ বিষয়ে কক্সবাজার সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রানাপ্রিয় বড়ুয়া জানান, শাহপরীর দ্বীপের বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ হলে বিধ্বস্ত সড়কটির কাজে হাত দেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, গত ২ মে সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ‘মোরা’য় ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ দিতে গিয়ে সড়কটির বেহাল দশায় পড়েছিলেন নিজেও। দীর্ঘদিন ধরে সড়কের এ অবস্থার জন্য তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদিকে দায়ী করে বলেছিলেন, ‘সরকারকে বেকায়দায় ফেলার উদ্দেশ্যে এরকম অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। ’ দীর্ঘকাল ধরে সড়ক ও বেড়িবাঁধের বেহাল অবস্থা নিয়ে এমপি বদির নীরবতায় মন্ত্রী প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের সদস্য নুরুল আমিন বলেন, ‘গত পাঁচ বছরে সাগরের ভাঙনে আমার ওয়ার্ডের ছয় শতাধিক ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। গৃহহারা মানুষ কোনো ধরনের সাহায্য সহযোগিতা পাননি। সীমাহীন কষ্টে দিনযাপন করছেন তাঁরা। ’
সাবেক স্কুলশিক্ষক জাহেদ হোসেন বলেন, ‘শাহপরীর দ্বীপ একটি সম্ভাবনাময় জনপদ। কিন্তু ভাঙনে গত পাঁচ বছরে দ্বীপের একটি বিশাল অংশ সাগরে তলিয়ে গেছে। বর্তমানে এ দ্বীপের আয়তন অনেকটা ছোট হয়ে আসছে। ’ তিনি মনে করেন, দ্রুত টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ হলে এ দ্বীপের অর্ধলক্ষ মানুষের অনিশ্চয়তা কেটে যাবে। দ্বীপবাসী দ্রুত বেড়িবাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন চান, ভাঙা সড়কের জোড়া চান।
কালেরকন্ঠ