নাহার মনিকা।।
আফ্রিদা মাহি নামের প্রতিভাবান মেয়েটি জীবনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মরে গেল। অনলাইনে ওর ছবিগুলো দেখে মুগ্ধ হবার পাশাপাশি ক্ষোভ আর দুঃখ হয়।
প্রতিভা আর প্রাণের কি বিরাট অপচয়!
ক্যুবেক এর নামকরা ফরাসি কথাসাহিত্যিক নেলী আরকানও ছত্রিশ বৎসর বয়সে আত্মহত্যা করে মরে গিয়েছিল ২০০৯ সালে। তার বই ‘বেশ্যা’ (পুত্যাঁন) ফ্রান্সে নামকরা ফেমিনা এবং মেডিসিস পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল (বইটিকে আমার অনুবাদ করার তালিকায় রেখেছি)।
মজার ব্যপার হচ্ছে এই লেখক পেশাদার এস্কর্ট অর্থাৎ পতিতাবৃত্তি বেছে নিয়েছিলো। তাকে নিয়ে একটি সিনেমা হয়েছে- নেলী। সম্প্রতি সিনেমাটি দেখলাম। দেখলাম নেলী কি করে ভার্জিনিয়া উলফ, সিলভিয়া প্লাথ এদের উত্তরসূরী হয়ে গেল। দেখতে দেখতে আফ্রিদা মাহি’র কথা মনে পড়ছিল। তীব্র একাকীত্বের বিষন্নতায় এরা কোন ভূত দেখে আবিষ্ট হয়ে নিজের হাতে নিজের প্রাণ হরণ করার মত ক্লিষ্ট কঠিন কাজ করতে পারে, বুঝতে পারি না!
আশাবাদের ঘটনাও আছে- মন্ট্রিলের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক হেথার ও’নীল, কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়েটিভ রাইটিং বিভাগে পড়াকালীন বিভাগের শিক্ষক দিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন প্রায় বছর বিশেক আগে। শিক্ষকটি কবি যশোপ্রার্থী ছাত্রীকে কবিতা ছাপানোর প্রলোভন দেখিয়ে, নামকরা প্রকাশক দিয়ে বই ছাপানোর লোভ দেখিয়ে শারিরীক সম্পর্কের জন্য ক্যাফে বারে, বাড়িতে ডেকে নিতো।
হেথার প্রথম প্রথম বিশ্বাস করে গেছেন, কিন্তু যেই বুঝে গেছেন যে শিক্ষকটি তার সাহিত্যের আগ্রহকে টোপ হিসেবে নিয়ে খেলছে, তিনি অনাগ্রহ দেখিয়েছেন। অমনি শিক্ষকটি তার সমস্ত প্রতিশ্রুতি তুলে নিয়েছে। এই ঘটনায় হেথার এতই ভেঙ্গে মুষড়ে পড়েছিলেন যে দীর্ঘকাল কাউকে বলেননি, বড়মাপের কোন পুরুষকে বিশ্বাস করা তার জন্য কঠিন হয়ে উঠেছিল। বললেও কাজ হতো না। বিভাগে এসব ঘটনা সকলের জানা গোপন বিষয় এবং শিকার কেবল হেথার একা নন।
ইতোমধ্যে বহু জল গড়িয়ে গেছে। হেথার লেখক হিসেবে বিখ্যাত হয়েছেন, গভর্নর জেনারেল এওয়ার্ড সহ গুচ্ছের সাহিত্য পুরস্কার তাঁর ঝুলিতে। এখন হেথার কোন অভিযোগ তুললে তার ওজন অনেক বেশী।
‘হ্যাশট্যাগ মি টু’- আন্দোলনে কন্ঠ মিলিয়ে এবার হেথার তার সেই অপমাণ আর অবমাননার কাহিনী বললেন, আর তাতে কাজ হলো। সঙ্গে সঙ্গে কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষমা চাইলো, তাদের তদন্ত কমিটি গঠিত হলো।
গতকাল সংবাদে শুনলাম যে এই বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্কের একটি গাইডলাইন প্রচার করেছে এই মর্মে যে – যদি কোন শিক্ষক কোন ছাত্র বা ছাত্রীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তাহলে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে। যদি তা না করেন, এবং কোন অভিযোগ ওঠে তাহলে শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সত্যি হলেও গল্পের মত এই কাহিনীটি বললাম এ কারণে যে একজন লেখকের অভিযোগের বিরুদ্ধে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এত দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার ঘটনা আমার কাছে অভিনব!
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রী হয়রানির লাগাতার অভিযোগ শুনি কিন্তু সমাধানগুলো চাক্ষুস করার সৌভাগ্য হয় না বা আমার মত সাধারণের চোখ এড়িয়ে যায়!
হেথার ও’নীলও নিজেকে নার্ভাস, কম সাহসী হিসেবে দাবী করেন। কে জানে হয়তো ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ দিয়ে অনুপ্রাণিত না হলে নিজের ঘটনা নিয়ে এগিয়ে আসার কথা ভাবতেনও না, হয়তো হেথারও দ্রোহের বদলে কোন গভীর আত্মপীড়নের পথ বেছে নিতেন, কে জানে!
সবার হয়তো না, তবে কারো কারো সামনে উদাহরণ লাগে, যুথবদ্ধ অনুপ্রেরণা তাঁর মত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা লেখকের জন্যও প্রয়োজন হয়।
তবে মাহি বা নেলী’র সংগে হেথারকে কোনভাবেই তুলনা করা চলে না। আমার আবেগ সর্বস্ব মন কেবল এমনটা ভাবে যে আহা কোনভাবে যদি এদের সামনে কেউ উদাহরণ হয়ে দাঁড়াতো!
মনোজাগতিক বিশ্লেষণ আমার কাজ না, আফ্রিদা মাহী, নেলী আরকান, সিলভিয়া প্লাথ এরা কেন স্বেচ্ছায় সরে যায় এটা না বুঝলেও অবুঝ প্রশ্নটা থাকেই – এই মানুষগুলোর ভেতরে পৃথিবী নামের সুন্দর গ্রহটি ছেড়ে না যাবার মত ভালোবাসা জাগানোর উপায় আছে কি?
(লেখকের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া)
পাঠকের মতামত