আমাদের মাঝে বিশেষ একটা ভূল ধারণা হলো ছোট ছোট শিশুদেরকে মসজিদে নেয়া যাবে না কিংবা গেলেও তাদেরকে সবার পিছনে অথবা একেবারে এক পাশেই দাঁড়াতে দিতে হবে। তাতে যতটা না সমস্যা তার চেয়ে বেশি সমস্যা এমনভাবে এটা বলা হয় অথবা এমন ব্যবহার তাদের এবং তাদের সাথের অভিভাবকের সাথে করা হয় সেটা। অভিভাবকরা অনেক সময় বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যান। অথচ আমরা জানি যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মসজিদে নববীতে সালাত আদায় করতেন তখন তাঁর নাতীদ্বয় হাসান ও হুসাইন (রা.) তাঁর ঘাড়ে চড়ে বসতেন। এমনকি তাদের এ খেলায় যেন ব্যাঘাত না ঘটে সে কারণে রাসূলুল্লাহ (সা.) সিজদাতে বিশেষ সময়ে ক্ষেপণ করতেন। সাহাবীরাও তা প্রত্যক্ষ করতেন। এমন কোনো হাদিস পাওয়া যায় না যে, রাসূল (সা.) শিশুদেরকে মসজিদে নিতে অনুৎসাহিত কিংবা নিষেধ করেছেন। বরং হজরত আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে পাই যে, তিনি (সা.) তাদেরকে মসজিদে এবং ঈদের মাঠে নিতে আদেশ করেছেন। (সহিহ বুখারি) এ ছাড়াও মসজিদে নবববী ছিল তখনকার পাঠশালা/স্কুল/মাদ্রাসা/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, শিশুরা সবাই শিক্ষা গ্রহণ করতেন। মসজিদ ছিল সকল প্রকার বিনোদন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের স্থান। সেখানে শিশুদের অবাধ চলাফেরাও ছিল স্বভাবিকভাবে। তাহলে আমরা কেন আমাদের বাচ্চাদের সাথে এমন ব্যবহার করবো?
কারো কারো একটা যুক্তি হয়ত দেয়া যেতে পারে যে, ছোট শিশুদেরকে মসজিদে নিলে তারা পেসাব-পায়খানা বা নোংরা করে দিতে পারে। এমন সম্ভাবনা থাকলে সাবধানতা অবলম্বন করা যেতে পারে। তাই বলে তাদেরকে মসজিদে নেয়া যাবে না তা কখনই হতে পারে না। তাছাড়া এখনতো বাচ্চাদের পরানোর জন্য প্যাম্পার্সধর্মী অনেক কিছু রয়েছে, এগুলোতে সে সম্ভাবনা আর থাকে না। সুতরাং এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি না করা উচিৎ।
অপরপক্ষ্যে একটা কথা চিন্তা করুন, ছোট বাচ্চাদেরকে যদি এ বয়সেই মসজিদে নেয়ার অভ্যাস না করি তাহলে ওদের অভ্যাসটা কীভাবে হবে? যেদিন তাদের উপর সালাত ফরজ হবে আর সকালে উঠেই যদি বলেন ‘চলো মসজিদে যাই’ আর ওমনি ও আপনার সাথে মসজিদে যাবে এমন ভাবা কতটা যৌক্তিক হবে বিবেচনা করুন। অন্যভাবেও চিন্তা করে দেখুন, যে সময়টা ও আপনার সাথে মসজিদে যাবে, আসবে এবং সালাতসহ অন্যান্য কাজে মগ্ন থাকবে সে সময়টাতে কিন্তু বাসায় পড়ালেখার পাশাপশি হয়ত বসে টিভি দেখা, কম্পিউটারে কিংবা মোবাইলে গেম খেলায় ব্যস্ত থাকে। ভার্সুয়াল জগতের আজকের শিশুদেরকে সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনে অভ্যস্থ করতে তাদেরকে ছোটবেলাতেই মসজিদমুখী করতে হবে।
দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে তাদেরকে মসজিদে নিলে একটা বিশেষ শিক্ষা তারা পাবে যাতে আরো জীবনমূখী হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। ইসলামের শিক্ষাটাও তেমন। চিন্তা করে দেখুন, বাংলা নববর্ষের দিন, কিংবা অন্যান্য সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামে শিশুদেরকে তাদের বাবা-মা কিংবা অভিভাবকরা ঘাড়ে চড়ে নিয়ে যায়। অপরপক্ষ্যে, ইসলামী অনুশাসনের বেলায় তাদের সাথে এমন আচরণ করা হয় যা তাদেরকে ইসলাম থেকে যোজন যোজন দূরে থাকতে উদ্ভূদ্ধ করছে। তারা হয়ত এসব ইসলামী কার্যক্রমের কথা জানতেই পারছে না।
মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে মসজিদে ছোট ছোট শিশুরা (ছেলে-মেয়ে উভয়ই) তাদের বাবা মায়ের সাথে ইতিকাফ পর্যন্ত করতে দেখা যায়। কা’বার চত্তরে তাওয়াফ করতে, সাঈ করতে, কাতারে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতে দেখা যায়। এটাই তো ইসলামের শিক্ষা। এ শিক্ষা থেকে আমরা আমাদের সন্তান, ভাই-বোনদেরকে দূরে রাখছি বলেই শিশুরা, যুবকরা জড়িয়ে পড়ছে অপসংস্কৃতিতে, ভিন্ন ভিন্ন অপরাধে। এসবের প্রতিকার এখন অবশ্যম্ভাবী। আপনার আমার একটু দৃষ্টিভঙ্গিই পরিবর্তন করতে পারে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। ভবিষ্যত প্রজন্ম গড়তে পারবে সুন্দর জীবন। শিশু ও যুবকদের অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িত হবার সম্ভাবনা কমে যাবে নিশ্চিত। সুতরাং আসুন আমরা আমাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করি। আল্লাহ আমাদেরকে কবুল আর মুঞ্জর করুন। আমিন।
লিখেছেন ড. মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক ও গবেষক।