মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘাত চলমান। এ পরিস্থিতিতে সীমান্তে কড়া পাহারায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এরপরও রামু, চকরিয়া, আলীকদম, লামা, নাইক্ষ্যংছড়ি, ফুলতলী, লম্বাশিয়া, ভাল্লুক খাইয়া, চাকঢালা ও দৌছড়িসহ কয়েকটি উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে শত শত গরু-মহিষ আসছে বাংলাদেশে।
অভিযোগ উঠেছে, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) মদদে দুই দেশে গরু-মহিষ ছাড়াও মাদকদ্রব্য পাচার করছে চোরা কারবারিরা। গরু চোরাই কারবারে মুনাফা বেশি হওয়ায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীও এখন ছুটছেন সীমান্তের চোরাই পথে। মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে কর্তব্যরত সীমান্তরক্ষী বিজিপি সদস্যদের মাথাপিছু ৫০০ টাকা দিয়ে গরু-মহিষ বাংলাদেশে পাচার করা হচ্ছে। সীমান্তের এপারেও সবাইকে ম্যানেজ করে গরু-মহিষ বাংলাদেশে আনা হচ্ছে। আর এ কাজে একাধিক সিন্ডিকেটের সদস্যরা রাত-দিন কাজ করছে। চোরাপথে এভাবে পশু পাচার করতে গিয়ে কেউ কেউ সীমান্তরক্ষীদের গুলির মুখে পড়ছেন, আবার কেউ কেউ দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হচ্ছেন।
সীমান্ত গলিয়ে চোরাই পথে মহিষ পাচার করতে গিয়ে সর্বশেষ গত রবিবার সকালে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ৪৭ নম্বর সীমান্ত পিলারের জারুলিয়াছড়ি সীমান্তে শূন্যরেখা থেকে কিছু ভেতরে মিয়ানমারের ভূখণ্ডের স্থলমাইন বিস্ফোরণে তিন বাংলাদেশি আহত হন। তারা হলেন- রশিদ উল্লাহ, মোহাম্মদ মফিজ উল্লাহ ও মো. আব্দুল্লাহ। তাদের সবার বাড়ি কক্সবাজারের রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মৌলভীকাটা গ্রামে। এদের মধ্যে মাইন বিস্ফোরণে মোহাম্মদ আব্দুল্লাহর দুই পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি বর্তমানে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালের ২ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। অন্য দুজনের হাত, বুক ও মুখ ঝলসে গেছে।
এর আগের দিন (গত শনিবার) রাতেও একই এলাকায় মাইন বিস্ফোরণে আহত হন আরও ২ বাংলাদেশি। তারাও অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে সীমান্তের ওপার থেকে গরু আনতে গিয়েছিলেন। মিয়ানমারে দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি ও সে দেশের সেনাবাহিনীর পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে তারা আহত হয়েছেন বলে ধারণা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সে দেশের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর যুদ্ধ চলার কারণে দুপক্ষই সীমান্ত এলাকায় ‘অ্যান্টিপার্সোনাল মাইন’ বা স্থলমাইন পুঁতে রেখেছে। এ পর্যন্ত ৩২ মাইন পুঁতে রাখার তথ্য মিলেছে। সীমান্তে চোরাচালানে জড়িত থাকা লোকজন এসব এলাকা ব্যবহার করতে গিয়ে প্রায়ই বিস্ফোরণের কবলে পড়ে হতাহত হচ্ছেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে।
গতকাল মঙ্গলবার পঙ্গু হাসপাতালে আহত আবদুল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, তিনি দিনমুজরের কাজ করেন। ৪ বছর ধরে মিয়ানমার থেকে গরু-মহিষ পাচারের কারবার চললেও একটু ভালো থাকার আশায় ২ বছর আগে এই কাজে যোগ দেন। দিনমজুরি করলে দৈনিক হাজিরা পাওয়া যায় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। সেখানে মিয়ানমার থেকে একটি গরু-মহিষ বাংলাদেশে এনে মহাজনের হাতে তুলে দিলে মেলে ২ হাজার টাকা। মিয়ানমারে বেলাল মহাজনের কেনা ২২টি মহিষ আনতে গত শুক্রবার রাতে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীদের জনপ্রতি ৫০০ টাকা দিয়ে সেই দেশে প্রবেশ করেন আব্দুল্লাহসহ ২৫ জন। গরু হাতে পেয়ে ২৫ জনই শনিবার রাতে ফুলতলী সীমান্তের ৪৭ নম্বর পিলার সংলগ্ন স্থান দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় কাঁটাতারের কাছাকাছি পৌঁছালে হঠাৎ একটি মাইন বিস্ফোরণে তাদের বহরের ২ জন আহত হন। ফলে সেই রাতে অন্যরা যাত্রা বিরতি দেয়।
তিনি আরও জানান, রবিবার সকাল ৮টার দিকে ফের মহিষ নিয়ে ফিরে আসার সময় সীমান্তের শূন্যরেখার কাছাকাছি প্রায় একই স্থানে আরেকটি মাইনের ওপর আব্দুল্লাহর পা পড়ে। এ সময় বিস্ফোরণ ঘটলে তার দু’পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়; আহত হয় আরও দুজন। একপর্যায়ে আব্দুল্লাহকে মৃত ভেবে ঘটনাস্থলে মহিষ রেখে তাকে ফেলেই সীমান্ত অতিক্রম করে পালিয়ে আসে বহরের অন্যরা। এদিকে পা উড়ে গেলেও জ্ঞান হারাননি আব্দুল্লাহ। দুই পা হারিয়ে রক্তাক্ত শরীর নিয়ে প্রায় ১০০ হাত হামাগুড়ি দিয়ে মিয়ানমারের স্থানীয় এক পরিবারের কাছে প্রাণ বাঁচানোর আকুতি জানায় আব্দুল্লাহ। তারাই প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে মিয়ানমার সীমান্ত রেখা পার করে দেন। খবর পেয়ে পরিবারের সদস্যরা এবং বিজিবি তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে চিকিৎসা নেয় মাইন বিস্ফোরণে আহত অন্য দুজনও। আব্দুল্লাহর অবস্থার অবনতি হলে সোমবার তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে সোমবারই পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় তাকে।
আব্দুল্লাহর বড় ভাই মো. তৈয়ব বলেন, একাধিকবার অস্ত্রোপচারের পর আব্দুল্লাহর বাম পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। চামড়ার ওপর কোনো রকমে ঝুলে থাকা ডান পা বাঁচিয়ে রাখার আশায় ক্লিপিংয়ের মাধ্যমে জোড়া দিয়ে রেখেছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু পা-টি বাঁচানোর আশা ক্ষীণ। ধারদেনা করে এ পর্যন্ত এক লাখ টাকা খরচ করেছেন তিনি। কিন্তু সামনে আরও অনেকবার অস্ত্রোপচার করার কথা বলেছেন চিকিৎসকরা। টাকার অভাবে এখন ভাইয়ের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে চোখে অন্ধকার দেখছেন বলেও জানান তিনি।
জানা গেছে, নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ফুলতলী, লম্বাশিয়া, ভাল্লুক খাইয়া, চাকঢালা ও দৌছড়ির পয়েন্টে চোরাই পথ দিয়ে প্রতিদিন অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে গরু-মহিষ এবং বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য। এসব অবৈধ পণ্যের চালান নিয়ন্ত্রণ করছে বিভিন্ন চোরাকারবারি চক্র। সন্ধ্যা নামলেই ফুলতলীর পথ দিয়ে চোরাই গরু আনার কাজ শুরু হয়। এরপর এশার নামাজের পর রাস্তাঘাটে লোকজন কমে গেলে গরুর পাল প্রশাসন ও বিজিবি টহল দলের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসে কারবারিরা। মিয়ানমার থেকে আনা চোরাই গরু পাহাড়ে ও খামারে মজুদ করে চোরাকারবারিরা। পরবর্তী সময় বাজার ইজারাদার থেকে রশিদ সংগ্রহ করে খামারির গরু পরিচয় দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করে থাকে। এতে করে মোটা অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। অন্যদিকে চোরাইপথে গরু-মহিষ আসায় সংকটের মুখে পড়েছেন নাইক্ষ্যংছড়ির ৫টি ইউনিয়ন ও কক্সবাজারের রামু, গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া ও ঈদগড়ের খামারিরা। বিভিন্ন সময় বিজিবির সদস্যরা সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে চোরাইপথে আনা শত শত গরু-মহিষ আটক করে। সেগুলো প্রশাসন ও বিজিবির উদ্যোগে নিলামে তুলে বিক্রি করা হয়।
নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আবদুল মান্নান জানায়, মিয়ানমার সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে ৩ জন আহত হওয়ার বিষয়টির তদন্ত চলছে। তদন্তের পর এই বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে। সুত্র: আমাদের সময়
পাঠকের মতামত