আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক::
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট বিশ্ববিপর্যয়ের এই সময়ে গণমাধ্যমের প্রয়োজন অনেক বেড়ে গেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী নিউজ কনজাম্পশন অনেক বেড়ে গেছে। আগে যাঁরা নিয়মিত গণমাধ্যমের সঙ্গে সংযোগ রাখতেন না, ব্যস্ততার কারণে সংবাদপত্র পড়ার সুযোগ পেতেন না, তাঁরাও এখন ঘরে বন্দি অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই গণমাধ্যমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছেন।
গণমাধ্যমই এই সংকটের সময়ে মানুষকে তথ্য দিচ্ছে, তথ্যের বিশ্লেষণ উপস্থাপন করছে। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে, সারা দেশ, সারা বিশ্ব এখন কোন জায়গায় অবস্থান করছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় ফ্রন্টলাইনে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের মধ্যে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা যেমন আছেন, এর সঙ্গে যুক্ত আছে গণমাধ্যমও। গণমাধ্যম ছাড়া তো মানুষ অন্ধকারে থাকবে। এই অবস্থায় গণমাধ্যমের কর্মী, সাংবাদিক, সম্পাদক, কলাকুশলী, সম্প্রচার ও মুদ্রণ মাধ্যমে যাঁরা আছেন, তাঁরাও এখন প্রথম সারির সৈনিক হিসেবে কাজ করছেন। সে কারণে গণমাধ্যমসংশ্লিষ্টদের ঝুঁকিও অনেক বেড়ে গেছে। সংবাদকর্মীদেরও সেসব জায়গায় যেতে হচ্ছে যেখানে করোনা আক্রান্ত রোগী রয়েছেন, যেখান থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটছে, সেসব জায়গায় গিয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা তথ্য তুলে আনছেন, ছবি সংগ্রহ করছেন। এটা করতে গিয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে পড়ছেন। কিন্তু এই কাজ না করেও তো কোনো উপায় নেই। পৃথিবীকে তো চলতে হবে, থেমে থাকলে হবে না। এসব কারণে গণমাধ্যমের যে গুরুত্ব সেটা সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করছে, সারা বিশ্ব উপলব্ধি করছে।
দুর্যোগের এই সময়ে একজন চিকিৎসাকর্মী যে প্রস্তুতি ও সুরক্ষা নিয়ে চিকিৎসাসেবা দিতে যাচ্ছেন, মাঠে কাজ করতে যাওয়া একজন সংবাদকর্মীর জন্যও একই গুরুত্ব দিয়ে সুরক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যে সংবাদকর্মী মাঠে যাচ্ছেন না, কিন্তু অফিসে কাজ করছেন তাঁকেও ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় করোনাযুদ্ধের ফ্রন্টলাইনের অন্যান্য যোদ্ধার জন্য যেভাবে ঝুঁকি ভাতার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, একইভাবে সংবাদকর্মীদের জন্যও ঝুঁকি ভাতার ব্যবস্থা, প্রণোদনার ব্যবস্থা করা দরকার, সেটি সারা বিশ্বই উপলব্ধি করছে।
এ ছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে যে সংকট তৈরি হয়েছে তাতে সংবাদপত্রও সংকটে পড়েছে। অনেকে ছাপা পত্রিকা পড়তে চাইছেন না। হকার না থাকায় অনেক জায়গায় সংবাদপত্র পৌঁছানোও যাচ্ছে না। বিজ্ঞাপন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় গণমাধ্যমগুলো যে সংকটে পড়েছে তা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের উচিত কিছুটা হলেও প্রণোদনা নিয়ে এগিয়ে আসা।
আরেকটি বিষয় এ মুহূর্তে জরুরি, সেটি হলো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। আমার মনে হয়, এ মুহূর্তে স্বাধীন গণমাধ্যমের যে গুরুত্ব তা সাধারণ মানুষ যেভাবে উপলব্ধি করছে, একই ভাবে বিশ্ব নেতারাও উপলব্ধি করছেন। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিত্জ এই কিছুদিন আগে বলেছেন, বিশ্বব্যাপী যে সংকট, এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রতিটি দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রয়োজন; ‘ফ্রি প্রেস’ দরকার। একই সঙ্গে গণমাধ্যম যে রিপোর্টগুলো করছে তা উপলব্ধি করার জন্য প্রয়োজন সংবেদনশীল সরকার। গণমাধ্যম স্বাধীন থাকলে এবং গণমাধ্যমকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য সংবেদনশীল সরকার থাকলে এই দুটির সমন্বয়ে যেকোনো সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। সংবেদনশীল সরকারের উদ্যম যেকোনো সংকট উত্তরণে ভূমিকা রাখে। সংকটকালে কোথায় কী হচ্ছে তা সাধারণ মানুষ কিংবা সরকার জানবে কী করে? গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করলে কোথায় কী হচ্ছে, কোথায় কী সংকট আছে তা যথাযথভাবে তুলে ধরলে সাধারণ মানুষ যেমন জানতে পারবে, সংবেদনশীল সরকারও—যদি সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করে—সে অনুসারে তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। করোনাসংকটকে সামনে রেখে এটা যেমন জোসেফ স্টিগলিত্জ বলেছেন, তেমনি নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও বলেছেন। তাঁর মতে, কোনো দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা, স্বাধীন সংবাদমাধ্যম থাকলে সে দেশে দুর্ভিক্ষ হওয়ার মতো কোনো কারণ থাকে না। কারণ দুর্ভিক্ষ তো ঘটে নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্য। গণমাধ্যম সক্রিয় থাকলে তা তাত্ক্ষণিকভাবে তুলে আনে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে আর সমস্যা থাকে না।
নানাভাবেই আমরা বুঝতে পারি, গণমাধ্যমের গুরুত্ব ও তাৎপর্য, বিশেষ করে সংকটকালীন সেটা আরো বেশি পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং এই অবস্থায় গণমাধ্যম নেতৃত্ব এবং সরকারের একটি সমন্বিত উদ্যোগ সংবাদপত্রের প্রকাশনা অব্যাহত রাখায় এবং সংবাদকর্মীদের সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক
অনুলিখন : আজিজুল পারভেজ
পাঠকের মতামত