দেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের সন্দেহে নামকরা ১১টি এনজিওর ওপর নজরদারি শুরু করেছে সরকার। দেশের আইন-প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর শীর্ষ পর্যায় থেকে এই নজরদারি রাখা হচ্ছে বলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে। সূত্রমতে, ২০১২ সাল থেকে নজরদারিতে রাখার ফলে জঙ্গি অর্থায়নের সন্দেহে থাকা এনজিওগুলো চাপে আছে। তাদের অর্থ আয়-ব্যয়ের দিকগুলোতে বাড়তি সতর্কতা রেখে চলেছে এনজিওবিষয়ক ব্যুরো। জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েত, কাতার, সৌদি ও যুক্তরাজ্য থেকে বিপুল পরিমাণে অর্থ আসছে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী সংশ্লিষ্টতায় পরিচালিত ১১টি এনজিওতে। এই এনজিওগুলো হলো— জামায়াতের কৃষক সংগঠন হিসেবে পরিচিত ‘বাংলাদেশ চাষী কল্যাণ সমিতি’, মুসলিম এইড বাংলাদেশ, রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামি, কাতার চ্যারিটিবল সোসাইটি, ইসলামিক রিলিফ এজেন্সি, আল ফুরকান ফাউন্ডেশন, কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটি, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ অর্গানাইজেশন (আইআইআরও), হায়াতুল ইগাছা, রিভাইবাল অব ইসলামিক হেরিটেজ সোসাইটি (আরআইএইসএস), তাওহিদী নুর এবং আল মুনতাদা আল ইসলামি। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এনজিওবিষয়ক ব্যুরো— পরিচালক (যুগ্ম সচিব) কে এম আবদুস সালাম বলেন, সন্দেহজনক এনজিওগুলোতে কড়া মনিটরিং করা হচ্ছে। জানা গেছে, ওই এনজিওগুলো থেকেই অর্থ পাচ্ছে জঙ্গিদের আত্মঘাতী গ্রুপের মধ্যে থাকা— কতল বাহিনী, শহীদ নাসিরুল্লাহ খান আরাফাত ব্রিগেড, আল্লাহর দল ব্রিগেড, আহসাব বাহিনী, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম—এবিটি, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ—জেএমজেবি, জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ—জেএমবি, শাহাদাত-ই-আল হিকমা, হিযবুত তাহ্রীর, হরকাত-উল জিহাদ-আল-ইসলামী বাংলাদেশ—হুজি এবং সরকারিভাবে কালো তালিকাভুক্ত সংগঠন— আল্লাহর দল, ইসলামী সমাজ, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি, তামির-উল-দীন বাংলাদেশ, তাওহিদ ট্রাস্ট নামের তথাকথিত জিহাদি জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা। এসব জঙ্গি সংগঠনসহ জামায়াত-শিবির ও বিভিন্ন ইসলামী দলের অনেক কর্মী বিদেশে রয়েছেন, যারা প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জঙ্গি সংগঠনগুলোকে সরবরাহ করছেন। সরকারিভাবে নিষিদ্ধ ও কালো তালিকাভুক্তসহ জঙ্গি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অথবা জঙ্গিবাদ সমর্থনকারী ইসলামী সংস্থার মতো ১৩২ জঙ্গি সংগঠনকে এক মঞ্চে জঙ্গিরা আনতে চায় বলে মনে করেন দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাত। তিনি ‘বাংলাদেশে মৌলবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি ও জঙ্গিবাদ : মর্মার্থ ও করণীয়’ শীর্ষক গবেষণায় বলেছেন, রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে যারা জঙ্গিত্বের প্রমোটার, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া এবং বহিষ্কার করতে হবে। মৌলবাদের ২৩১টি বেসরকারি সংস্থার অর্থ আসে বিদেশ থেকে। মৌলবাদী আদর্শে পরিচালিত বিভিন্ন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের এখন বার্ষিক মুনাফার পরিমাণ ২ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। আর ১৯৭৫ থেকে ২০১৪ এই ৪০ বছরে মৌলবাদের অর্থনীতির মোট পুঞ্জীভূত মুনাফার পরিমাণ ২ লাখ কোটি টাকা। মৌলবাদী অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ। এই অর্থ দিয়ে তারা ৫ লাখ ফুলটাইম রাজনৈতিক কর্মী নিয়োগ করতে পারেন। যদিও পবিত্র কোরআন শরিফে জিহাদ বলে কিছু নেই। কিন্তু মৌলবাদী-জঙ্গিরা জিহাদের নামে দেশের ১৩২টি জঙ্গি সংগঠনকে এক মঞ্চে (প্লাটফর্ম) আনতে চায়। আল-কায়েদা জঙ্গিদের মূল রাজনৈতিক সংগঠন এবং আইএস তাদের মিলিট্যান্স। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘কমবেটিং টেরোরিজম সেন্টারের’ তথ্যমতে, বাংলাদেশ অবৈধ অর্থে ভরপুর। সন্ত্রাসীরা এই অবৈধ অর্থ প্রবাহের বড় সুবিধা ভোগ করছে। ভারত থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ পণ্য চোরাচালান হয়ে বাংলাদেশে আসে, যার সঙ্গে উভয় দেশের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোও সম্পৃক্ত। ক্ষুদ্র অস্ত্র, মাদক ও জাল ডলার ছাপানোও বাংলাদেশের জঙ্গিদের অর্থায়নের উৎস। এর বেশির ভাগই বাংলাদেশে প্রবেশ করে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল ও মিয়ানমার হয়ে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় ঢাকায় অভিযান চালিয়ে জেএমবির যেসব নিরাপদ আস্তানার খোঁজ মেলে, তার বেশির ভাগেরই মালিক সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশিরা। জানা গেছে, দেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়নের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স অবস্থান নিয়েছে সরকার। মুদ্রা পাচার ও চোরাচালানের মাধ্যমে দেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন হচ্ছে। দেশে সিএসআরের নামে বিভিন্ন জিহাদি প্রকল্পে জঙ্গি-সন্ত্রাসী অর্থায়ন হলেও সেখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজরদারি নেই। আর জঙ্গি অর্থায়নে ব্যাংক-বীমা ও এনজিও খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের দাবি, আর্থিক খাতে তাদের কঠোর নজরদারি আছে।
এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বলেন, জিহাদিকরণ প্রক্রিয়াতে ধর্মীয় চ্যারেটির মাধ্যমে অর্থায়ন হচ্ছে। সেখানে বিভিন্ন ফাঁকফোকর দিয়ে অর্থ বেরিয়ে যাচ্ছে। এই ফাঁকফোকরগুলো বন্ধ করে সরকারি নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-বিএফআইইউর সর্বশেষ প্রকাশিত ‘বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৪’ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ব্যাংক, বীমাসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সন্দেহজনক লেনদেনের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এসব লেনদেনে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে না। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে এ ধরনের সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে ৬১৯টি। আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ৪২০টি। আর ২০১১-১২ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেনের সংখ্যা ছিল ১৭৫টি। এর আগে ২০১৪ সালের আগস্টে ‘জঙ্গিবাদের অর্থের উৎস অনুসন্ধান কার্যক্রম অধিকতর সমন্বয়ের লক্ষ্যে টাস্কফোর্স’ গঠন করে সরকার। সূত্রমতে, জঙ্গিগোষ্ঠীকে অর্থদাতাদের একটি তালিকা নিয়ে কাজ করছে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। বেসরকারি একটি ব্যাংকসহ একাধিক এনজিও ও জামায়াত প্রভাবিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এ তালিকায়। জঙ্গি বিস্তারে নেপথ্য ভূমিকায় থাকা অর্থদাতাদের রাজনৈতিক পরিচয় বের করতেও দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। ওই টাস্কফোর্সের কার্যবিবরণীতে বলা হয়, দেশব্যাপী বিভিন্ন মাধ্যমে জঙ্গি অর্থায়ন হচ্ছে। ইসলামী সংগঠনগুলোর জমি ক্রয়-বিক্রয়, ফ্ল্যাট ব্যবসা ও মার্কেট নির্মাণের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি শক্ত করছে। সংস্থাগুলোর কাছে তথ্য আছে, এসব ব্যবসার টাকা থেকে বৃত্তি দিয়ে শতাধিক ডাক্তার, ব্যারিস্টার, বিচারক, আইনজীবী ও পিএইচডিসহ উচ্চশিক্ষিত শ্রেণি তৈরি করা হচ্ছে। প্রয়োজনের সময় যাতে এই শ্রেণি তাদের পাশে দাঁড়ায়। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে আইনিভাবে শক্ত অবস্থান তৈরির মাধ্যমে যে কোনো পরিস্থিতি অনুকূলে রাখার অংশ হিসেবে তারা এ ধরনের কাজ করছে। জঙ্গি সংগঠনগুলো দেশে বেশ কিছু বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, হাসপাতাল, ক্লিনিক, কোচিং সেন্টার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তথাকথিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জঙ্গি তত্পরতা ও সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
bd-pratidin.