কিশোর এবং কিশোরী, দু’জনের বয়সই ১৮ এর নিচে। সংশ্লিষ্ট কিশোর রাজধানীর প্রতিষ্ঠিত একটি কলেজ থেকে সদ্য এইচএসসি পাস করেছে। আবার কিশোরীও নামকরা একটি কলেজের এইচএসসি ১ম বর্ষের ছাত্রী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তাদের পরিচয়। অতঃপর প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া। পার্কে, হোটেলে, রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ানো, যেন এক রঙিন জগতে তাদের বিচরণ। ইন্টারনেটে ছবি ও ভিডিও আদান প্রদানের অ্যাপ ইনস্টাগ্রাম ও স্ন্যাপচ্যাটের মাধ্যমে নিজ শরীর খোলামেলা অবস্থায় লাইভ ভিডিও চ্যাটিং ও শেয়ার করা ছিল উভয়ের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। এমন পরিস্থিতিতে দু’জনের কৈশোর মনে চেপে বসে অন্তরঙ্গ হওয়ার প্রবল ইচ্ছে। অতঃপর দু’জনের সম্মতিতেই শুরু হয় সেই ইচ্ছার বাস্তবায়ন। এক পর্যায়ে ভবিষ্যতে বিয়ের সম্পর্কে জড়াবে এমন প্রতিশ্রুতিও দেয় একে অপরকে।
তবে ওই কিশোরীর মাদকাসক্তি এবং অন্য ছেলেদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশায় তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরায়, অনেক চেষ্টা করেও কিশোরীকে সে পথ থেকে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়ে প্রেমের সম্পর্ক থেকে সরে দাঁড়ায় কিশোর প্রেমিক। এক পর্যায়ে ঘটনাটি অভিভাবক পর্যায়ে পৌঁছালে কোনো সুরাহা না হয়ে শেষ পর্যন্ত বিষয়টি ধর্ষণ মামলায় গিয়ে গড়ায়।
জাতীয় পরিচয় পত্র ও শিক্ষা সনদ অনুযায়ী ওই কিশোরের জন্ম তারিখ ২০০৩ সালের ২৮ আগস্ট। অর্থাৎ এখনও ১৮ বছর হয়নি, তবে কিশোরীর বাবার দায়ের করা মামলায় কিশোর প্রেমিকের বয়স উল্লেখ করা হয়েছে ২০ বছর। গত ২৯ অক্টোবর রাজধানীর ভাটারা থানায় মামলাটি হয়। মামলা নং-৮৬। ৯ (১) ধারায় দায়ের করা মামলায় বলা হয়- ‘ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক ধর্ষণের অপরাধ’।
বাদীর অভিযোগ অনুযায়ী- ২০১৮ সালে তার মেয়ের সঙ্গে ওই কিশোরের পরিচয়। ফেসবুকে চ্যাটিং এর মাধ্যমে তাদের পরিচয় এবং এক পর্যায়ে তারা একে অপরের সঙ্গে দেখা করা এবং পার্কে হোটেলে গল্প-গুজব ও আড্ডা চালিয়ে যেতে থাকে। পরবর্তীতে ওই কিশোরী তার মাকে সম্পর্কের বিষয়টি জানালে, এতো অল্প বয়সের প্রেম-ভালোবাসাকে গুরুত্ব না দিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে বলেন। এরপরও আবেগের বশবর্তী হয়ে ওই কিশোরী প্রেমিক কিশোরের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বজায় রাখে। দেশে লকডাউন চলাকালীন ওই কিশোরী তার গ্রামের বাড়িতে অবস্থানকালীন চলতি বছরের জুলাই মাসে ওই কিশোর সেখানে যায়, বিষয়টি কিশোরীর পরিবারের কাছে বিব্রতকর হলে তারা ওই কিশোরকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। এরপর এইচএসসি শিক্ষাবর্ষে ভর্তির জন্য কিশোরী ঢাকায় আসে। ঢাকায় অবস্থানকালীন গত ৩০ আগস্ট বিকেলে কিশোরীকে ওই কিশোর বিয়ের কথা বলে রাজধানীর বারিধারার জে ব্লকের একটি হোটেলের দ্বিতীয় তলার কক্ষে নিয়ে যায়। এরপর এক ব্যক্তিকে হুজুর সাজিয়ে বিয়ের নাটক করে। পরে সেই ব্যক্তি চলে গেলে বলে- ‘আজ থেকে আমরা স্বামী-স্ত্রী’। ওই দিন রাতে তারা সেই হোটেলেই একসাথে রাত কাটায়। ওই রাতে প্রেমিক কিশোর তার প্রেমিকা কিশোরীকে ‘ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক ধর্ষণ’ করে। এরপর থেকেই ওই কিশোর তার প্রেমিকার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। বিষয়টি কিশোরী অভিভাবককে জানালে তারা অভিযুক্ত কিশোরের পরিবারকে জানায়, কিন্তু তারা গুরুত্ব না দিয়ে অসহযোগিতা করে।
অন্যদিকে এই মামলা দায়েরের ২০ দিন আগে, গত ৯ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন কিশোরের মা। জিডি নং-৭৫৪। জিডি কপিতে সংশ্লিষ্ট কিশোরীর বয়স ১৯ উল্লেখ করা হলেও, তার প্রকৃত বয়স ১৮ বছরের নিচে।
কিশোরের মা জিডিতে উল্লেখ করেন, কিশোরী তার ছেলের পূর্ব পরিচিত। সে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকার একটি গার্লস হোস্টেলে থাকে। কিশোরের সাথে ওই কিশোরী একতরফাভাবে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করে। পরে সে গত ৭ আগস্ট রাত ৯ টায় কিশোরের পারিবারিক বাসভবনে এসে প্রেমের সম্পর্ক গড়তে চাপ প্রয়োগ করে। যাতে ওই কিশোরীর বাবা এবং মা ইন্ধন যোগায়। এমন পরিস্থিতিতে কিশোর, ওই কিশোরীর সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়তে না চাওয়ায় বিবাদীরা বিভিন্ন মামলা-হামলা করে প্রেম করতে বাধ্য করার জন্য ভয় ভীতি ও হুমকি দেয়।
দুই পরিবারের পাল্টাপাল্টি এসব অভিযোগের বিষয়ে আরটিভি নিউজ দুই পক্ষের সঙ্গেই কথা বলার চেষ্টা করে। কিশোরের চাচা বলেন, পড়াশোনা করা কিশোর-কিশোরীর অবাধ সম্পর্ককে আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। তারা এখনও প্রাপ্ত বয়স্ক হয়নি। তাছাড়া মূল সমস্যা হলো, ওই কিশোরী মাদকাসক্ত এবং অন্য ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করে, যা সম্পর্কের শুরুতে আমার ভাতিজা বুঝতে পারেনি।
অন্যদিকে এসব অভিযোগের বিষয়ে ওই কিশোরীর বাবার সঙ্গে গত বুধবার (৪ নভেম্বর) এবং গতকাল বৃহস্পতিবার (৫ নভেম্বর) পরপর দুইদিন মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি অসুস্থ এবং হসপিটালে ভর্তি আছেন উল্লেখ করে, পরে কথা বলবেন বলে জানান।
এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ভাটার থানার এসআই মিজানুর রহমান আরটিভি নিউজকে বলেন, সংশ্লিষ্ট মামলায় আসামিকে (কিশোরকে) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সে বর্তমানে কারাগারে বন্দি আছে। ভিক্টিমের (কিশোরীর) মেডিকেল টেস্ট করা হয়েছে। সার্বিক তদন্ত এবং মেডিকেল রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। এছাড়াও গ্রেপ্তারকৃত যদি কিশোর বয়সী হয়, এবং তদন্তে তার দোষ পাওয়া যায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পত্রের পরিবর্তে দোষীপত্র দেওয়া হবে। যার বিচার হবে কিশোর আদালতে।
স্বেচ্ছায় দৈহিক সম্পর্কে জড়িয়েও “ধর্ষণ” মামলা দায়ের করার ঘটনা কেবল একটি নয়, দেশে এমন একাধিক ঘটনা রয়েছে। যা বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে উঠে আসে এবং আদালতে প্রমাণিত হয়।
পুরুষদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে এমন একটি দেশীয় সংগঠন ‘এইড ফর মেন ফাউন্ডেশন’। এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম নাদিম আরটিভি নিউজকে বলেন, ধর্ষণ মামলাগুলোর অধিকাংশই পুরুষদের হয়রানির জন্য করা হচ্ছে। সচেতনভাবে নারী এবং পুরুষ উভয়ের সম্মতিতে শারীরিক সম্পর্ক হলেও দায় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে কেবল পুরুষের উপর! এটি চরম বৈষম্য। এমন অনেক ভুক্তভোগী পুরুষ আমাদের কাছে আসেন। আইন সবার জন্য সমান, তাহলে কেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অপব্যবহার করে কতিপয় অসাধুরা পুরুষদের হয়রানি করে চলছে, চাপ প্রয়োগ করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা চাই আইনে পুরুষ-নারী বিভাজন না করে সমান বিবেচনায় আইন প্রয়োগ ও দোষী হলে বিচার করা হোক। প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ও নারী উভয়ের ইচ্ছায় শারীরিক সম্পর্ক হলেও ধর্ষণ মামলার মাধ্যমে এর দায় কেবল ‘পুরুষের’ উপর চাপিয়ে দিলে হবে না, এতে নারীও সমানভাবে অভিযুক্ত হতে হবে, তার বিরুদ্ধেও মামলা দেওয়ার আইন থাকা জরুরি। এটি আইন ও বিচারের ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য।
তিনি আরও বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রুল জারি করেছে, কোনো নারী সম্মতির ভিত্তিতে এক সঙ্গে অবস্থানের পর ওই পুরুষের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করতে পারবেন না। এমনকি ওই পুরুষ যদি তাকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানায়, সে ক্ষেত্রেও এ ধরনের অভিযোগ করার সুযোগ নেই।
ঢাকা বারের সাবেক সভাপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কাজী নজিবুল্লাহ হিরু আরটিভি নিউজকে বলেন, আমাদের দেশের বিদ্যমান আইনে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক করে বিয়ে না করলে সেটিকে ‘ধর্ষণ’ বলা হয়।
ধর্ষণের মামলায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষরা হয়রানির শিকার হচ্ছে, এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে বিজ্ঞ এই আইনজীবী বলেন, ‘আমি মনে করি এ ক্ষেত্রে আমাদের আইনকে আরও আধুনিকায়ন করা দরকার। আরও বিভিন্ন ডাইমেনশন আছে, বিভিন্ন মুড আছে যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে। সেটার সঙ্গে মিলে আমাদের আইনকে আরও বেশি যুগোপযোগী করতে হবে।
আন্তর্জাতিক প্রো বোনো অ্যাওয়ার্ড-২০২০ এ মনোনীত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান আরটিভি নিউজকে বলেন, যেসব নারী প্রকৃতপক্ষে ধর্ষণ বা নির্যাতনের শিকার তাদের অধিকাংশই মামলা করতে চান না, বিষয়টি গোপন করতে চান। কিন্তু এই আইনের সুযোগ নিয়ে অনেকে বিভিন্ন মানুষকে ফাঁসানো জন্য ধর্ষণ মামলা দিয়ে হেনস্তা করে চলছেন। যেহেতু এই ধারার মামলা স্পর্শকাতর, সেহেতু এসব মামলা এলে আদালত এক রকম চাপে পড়ে। এর অন্যতম কারণ, জামিন হলেই গণমাধ্যমগুলো নিউজ করে “ধর্ষণ মামলায় জামিন দিয়েছেন আদালত”। যা ফলাও করে গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। যে কারণে সন্দেহভাজন পুরুষ, ধর্ষণ মামলায় জামিনের যোগ্য হলেও তা আটকে যায়।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে ১৯ হাজার ৬৮৩টি নারী নির্যাতন মামলা হয়েছে, ২০১২ সালে ১৯ হাজার ২৯৫টি, ২০১৩ সালে ১৮ হাজার ৯১টি, ২০১৪ সালে ১৯ হাজার ৬১৩টি, ২০১৫ সালে ১৯ হাজার ৪৮৬টি, ২০১৬ সালে ১৬ হাজার ৭৩০টি, ২০১৭ সালে ১৫ হাজার ২১৯টি, ২০১৮ সালে প্রায় ১৭ হাজার, ২০১৯ সালে ১৫ হাজার, ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ৭ হাজারের মতো নারী নির্যাতন মামলা দায়ের হয়েছে। এসব মামলার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হয়রানির উদ্দেশ্যেই করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। সুত্র: আরটিভি