সাংবাদিকদের বলা হয় জাতির বিবেক। আর গণমাধ্যম হচ্ছে সমাজের দর্পণ। এ সাহসী পেশায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অকালে প্রাণ হারিয়েছেন অনেক সাংবাদিক। অনেকে হয়েছেন নির্যাতিত, হয়েছেন হয়রানির শিকার। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের সাতাশটি দেশে এখন পর্যন্ত হত্যা করা হযেছে ৯০ জন সাংবাদিককে। তাহলে সাংবাদিকদের কলম কি কখনো স্বাধীনতা পাবে না?
একজন সাংবাদিকের দোষ কি তাহলে সত্য তুলে ধরা? জতির বিবেক হয়ে যদি দেশের মাটিতে স্বাধীনতা না থাকে তাহলে কি করে চলবে এ কলম? রাষ্ট্রযন্ত্র কেনই বা সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি আমলে নেয় না?
এদিকে কয়েকদিন ধরে আলোচনায় রয়েছে ৫৭ ধারা আইন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। এই আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহলে তার এই কার্য হবে একটি অপরাধ। এই অপরাধের জন্য অনধিক ১৪ বছর ও অন্যূন ৭ বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ড দেওয়া যাবে। ২০০৬ সালে আইসিটি আইন প্রণয়ন করা হয়। ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধন করা হয়।
একজন প্রকৃত সাংবাদিক সব সময় দেশের সংবিধান ও আইন মেনেই চলেন। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কোন খবর তৈরি করেন না। এখানে একটা কথা না বলে পারছি না, সমাজে কিছু হলুদ সাংবাদিক রয়েছে। এদের কারণেই দেশের রাষ্ট্র, সরকার ও জনগণের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। আর এদের কারণেই আজকের এই ৫৭ ধারা।
আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি, সাংবাদিকরা কোন কালেই কারো প্রতিপক্ষ ছিলেন না। এখনও নেই এবং আগামীতেও থাকবে না। সুস্থ ও সুন্দর ভবিষ্যত বিনির্মাণের লক্ষ্য নিয়েই তারা এই শঙ্কাকুল পেশায় কাজ করেন। রাষ্ট্রযন্ত্রকেও মাথায় রাখতে হবে যে, সাংবাদিকরা দুরন্ত সাহস নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেন। এজন্যই নানা অনিয়ম-দুর্নীতি রুখে দেওয়া যায়। জনগনের অর্থ লোপাট বন্ধ হয়। গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকে। জনকল্যাণ নিশ্চিত করা যায়। সরকারের উচিত হবে, দেশের স্বার্থে সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করা।
এই আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহলে তার এই কার্য হবে একটি অপরাধ। এই অপরাধের জন্য অনধিক ১৪ বছর ও অন্যূন ৭ বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ড দেওয়া যাবে।
এদিকে সংবিধানের ৩৯(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘৩৯। (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল। (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ আইনজীবীদের মতে, সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদের ২(ক)-এর সঙ্গে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা সাংঘর্ষিক। এখানে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আইসিটি আইনে তাতে বাধা দেওয়া হয়েছে।
আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুন্য হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহা ইহলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।’ ‘(২) কোন ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক চৌদ্দ বৎসর এবং অন্যূন সাত বৎসর কারাদন্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদন্ড দন্ডিত হইবেন।’ অন্যদিকে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২-এর ৮(৩) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি ইন্টারনেট বা ওয়েবসাইট বা মোবাইল ফোন বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি সরবরাহ করিলে তিনি অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন এবং উক্তরূপ অপরাধের জন্য তিনি সর্বোচ্চ ৫ (পাঁচ) বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদ- এবং ২,০০,০০০ (দুই লক্ষ) টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডিত হইবেন।’ আইনজ্ঞদের মতে, একই ধরনের অপরাধে দুই আইনে দন্ডের এমন পার্থক্য এক ধরনের বৈষম্য। একই সঙ্গে এটা সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, আমরা বসে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আলাপ-আলোচনা করে যেসব কথা বেরিয়েছে সেটার একটা রূপরেখা করে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মধ্যে এনে আগামী আগস্ট মাসে চূড়ান্ত ড্রাফট নিয়ে নিয়ে আবার মিটিংয়ে বসব। সেই মিটিংয়ে আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব। সেখানে ৫৭ ধারা সম্বন্ধেও আমাদের সিদ্ধান্ত আপনারা পাবেন। কিন্তু এখন আমরা কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হইনি বলেই এর বেশি আর কিছু বলতে চাই না।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ২৬ জুলাই এ আইন সংশোধনের আগে ৪৬ ও ৫৭ ধারা কেন অবৈধ নয়, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। তাতে বলা হয়েছিল, ‘আইনের ৫৭ ধারায় ইলেকট্রনিক ফর্মে লেখা অশ্লীল অথবা মানহানিকর তথ্য প্রকাশ-সংক্রান্ত অপরাধ ও দ-ের বিষয়ে বলা আছে।’ এ ধারামতে, ‘ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ইলেকট্রনিক বিন্যাসে কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা, অশ্লীল বা যে প্রকাশনা দেখলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ উদ্দেশ্য মনে জাগতে পারে, তার জন্য জরিমানার বিধান আছে। কিন্তু ব্যক্তি যে নীতিভ্রষ্ট বা তার মনে যে অসৎ উদ্দেশ্য জেগেছে, তা মাপার কোনো মানদ- নেই।‘ যদিও পরে আর ওই রিটের রুলের শুনানি হয়নি।
আরেফিন সোহাগ
লেখক ও সাংবাদিক
বিডি২৪লাইভ