কড়া রোদ উপেক্ষা করে আদালতের গারদখানার প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন অসংখ্য নারী-পুরুষ। এরই মধ্যে আসামি বহনকারী প্রিজনভ্যানগুলো এক-এক করে গারদখানায় যাচ্ছে। বেরোচ্ছে খালি হয়ে। যখনই কোনো প্রিজনভ্যান গারদখানায় যাচ্ছিল জটলাবেঁধে থাকা মানুষ মাথা উঁচু করে দেখছিল ভ্যানের ওপর দিকে। কেউবা চিৎকার করে আটক-গ্রেপ্তার বা ‘নিখোঁজ’ স্বজনের নাম ধরে ডাকছিল। বেলা গড়াচ্ছিল। একসময় গারদের গেটে এসে ঠেকল রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার প্রিজনভ্যান। তখন ভ্যানের ভেতর থেকে কেউ চেঁচিয়ে বলল, ‘মা আমি আল আমিন। ময়ূরী ভিলার সামনের দোকান থেকে বাবুর দুধের কৌটা নিয়ে নিও’। ততক্ষণে প্রিজনভ্যানটি ভেতরে ঢুকে গেল। এটি গত বুধবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের গারদখানার সামনের চিত্র।
কথা হয় আল আমিনের মা রোকেয়া বেগমের সঙ্গে। সাংবাদিক পরিচয় দিতেই তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘মিথ্যা কমু না, আমার পোলাডা একসময় ইয়াবা খাইত। কিন্তু এ্যাহন খায় না, বেচেও না। কিন্তু পুলিশ ওরে ধইরা থানার লকআপে ঢুকায়। কয় ওর লগে নাকি ইয়াবা ছিল। পরে মঙ্গলের পোলারে লইয়া থানায় গেলে পুলিশ এক লাখ টাকা চায়। আমরা এত টাকা দিমু ক্যামনে। তবুও রাইতে ছাইড়া দিতে ১০ হাজার টাকা দিতে রাজি হই। কিন্তু পুলিশ কয়, ৫০ হাজার টাকা না দিলে ৫০ পিস ইয়াবাসহ কোর্টে চালান দিব। পরে আদালত থেকে ছাড়াইয়া নিতে। আমরা টাকা দিতে না পারায় পুলিশ তারে চালান দিছে’।
রোকেয়া বেগম আরও জানান, তারা মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ির ৩১/এ নম্বর বাড়িতে থাকেন। আল আমিন তিনরাস্তা বেড়িবাঁধের একটি ট্রাকে ইট-বালু সরবরাহের কাজ করেন। গত সোমবার রাত ১১টার দিকে তিনি তার চার মাসের শিশুসন্তানের জন্য বেড়িবাঁধ থেকে একটি গুঁড়ো দুধের কৌটা নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। সেই সময় মোহাম্মদপুর থানার এসআই নয়ন তাকে ধরে থানায় নিয়ে যান। রাতে থানায় গিয়ে স্বজনরা আল আমিনের সঙ্গে কথা বলেন। থানায় পুলিশের সামনেও আল আমিন ইয়াবার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
শুধু রোকেয়া বেগম নন, ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর এমন অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। জানা গেছে, পুলিশ বাহিনীর একশ্রেণির অসাধু সদস্য রাস্তায় চেকপোস্ট, টহল, সাদা পোশাকে তল্লাশির নামে যার-তার পকেট বা হাতে ইয়াবা ধরিয়ে দিয়ে বড় অঙ্কের অর্থ আদায় করছে। এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে আটকের পর দেনদরবার করে টাকা দিলে থানা থেকেই মুক্তি মেলে। নয়তো ইয়াবা উদ্ধার দেখিয়ে নিরপরাধ মানুষকে চালান দেওয়া হয় আদালতে। এদিকে দাবিকৃত টাকা দিয়েও পুরোপুরি নির্ভার হতে পারেন না ভুক্তভোগীরা। আটকের বিষয়টি জানাজানি হলে টাকা নিয়েও তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়। এ ছাড়া কোনো ইয়াবা ব্যবসায়ী, যিনি এ পথ ছেড়ে দিয়েছেন, তাকেও যখন-তখন আটক করে চলে পুলিশের আটক ও গ্রেপ্তার-বাণিজ্য।
এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশে সম্প্রতি জঙ্গিবাদের ঘটনা ঘটছে। নাগরিককে সঙ্গে রেখে পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জঙ্গিবাদ দমন করতে হবে। এ জন্য পুলিশের প্রতি সবার আগে মানুষের আস্থা বাড়াতে হবে। কিন্তু কতিপয় পুলিশ সদস্য যদি ইয়াবা দিয়ে নাগরিককে হয়রানি করেন, তাহলে মানুষের আস্থা অর্জন করা কঠিন হবে। এটি নাগরিকের সুশাসনের চরম অন্তরায়।
অন্যদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) মো. মাসুদুর রহমান বলেন, মাদকদ্রব্য চোরাচালান প্রতিরোধে পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিভিন্ন সময় মাদকদ্রব্য বিশেষ করে ইয়াবা চোরাচালানকারী বা সরবরাহকারীকে আইনের আওতায় এনেছে। কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর ঘটনা ঘটলে তদন্তসাপেক্ষ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মাদকের মামলা পরিচালনাসংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, রাজধানীর প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় মাদকদ্রব্য, বিশেষ করে ইয়াবার “োর বিকিকিনি চলছে। এমনকি গ্রামগঞ্জেও এ মাদকের বিস্তার ঘটেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইয়াবার পাইকারি বিক্রেতা আটক বা গ্রেপ্তারের সংখ্যা খুবই নগণ্য। মাঝেমধ্যে খুচরা বিক্রেতা বা সরবরাহকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। অন্যদিকে ইয়াবাসংক্রান্ত মামলার বেশিরভাগই সাজানো। অবশ্য ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হওয়ার পর অস্বীকার বা পুলিশের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করার ঘটনাও ঘটছে।
গত ৩০ আগস্ট মিরপুরের রূপনগর থেকে আটক করা হয় বিসিআইসি কলেজের ছাত্র মুজাহিদকে। তার ভাই মাসুম বলেন, আমার ভাইয়ের ইয়াবা সেবন বা ব্যবসা দূরের কথা ছোটখাটো কোনো অপরাধেরও রেকর্ড নেই। রূপনগরে আমাদের জমি আছে। সম্পত্তিসংক্রান্ত কারণে শত্রু থাকতেই পারে। হয়তো পুলিশ কোনো শত্রুর পক্ষ নিয়ে আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে ইয়াবার মামলার নাটক সাজিয়েছে।
এদিকে ১৬ আগস্ট কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার টনকী ইউনিয়নের বাইড়া গ্রামের এক মেয়ে ও তার মাকে আটক করে থানা পুলিশ। পুলিশের দাবি, মেয়েটির ঘরের তোশকের নিচে ২২টি ইয়াবা পাওয়া গেছে। তবে তাদের স্বজনরা জানান, মেয়েটির সঙ্গে টনকী ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত মেম্বার রাশেদের সাত বছরের প্রেম ছিল। বিয়ের শর্তে নির্বাচনের সময় মেয়েটির কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা ধার নেন রাশেদ। কিন্তু নির্বাচনের পর মেম্বার বিয়ে করতে গড়িমসি করেন। এতে মেয়েটির আত্মীয়স্বজন ও এলাকাবাসী তাকে চাপ সৃষ্টি করলে এ নিয়ে সালিশও হয়। পরবর্তীকালে মেম্বারের সাজানো ‘ইয়াবা নাটকে’র ফাঁদে পড়েন ওই মেয়ে ও তার মা।
ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগে গত ২৭ জুলাই লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মহাদেবপুরে বাবু হোসেন নামে এক ডাব ব্যবসায়ীকে আটক করে দালাল বাজার পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই সোহেল মিয়া। তার দায়ের করা এজাহারে বলা হয়, মহাদেবপুরের নুরানিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা এলাকায় মাদকদ্রব্য কেনাবেচা হচ্ছে। এ সংবাদের ভিত্তিতে তিনি ফোর্স নিয়ে অভিযান চালান। ঘটনাস্থলে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে বাবু দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। পরে তাকে আটক করে তার দেহ তল্লাশি করে শার্টের বুকপকেটে ২০ পিস ইয়াবা পাওয়া যায়। এদিকে বাবুর স্ত্রী নিপা আক্তার বলেন, আমার স্বামী ডাব বিক্রি করে কোনোমতে সংসার চালান। যখন পুলিশ আটক করে, তখন তিনি স্যান্ডো গেঞ্জি পরা ছিলেন। পুলিশ শার্ট পেল কোথায়? আর পকেটই বা পেল কোথায়? তারা মিথ্যা মামলা দিয়েছে। স্থানীয়রা জানান, বাবুর স্ত্রী নিপার আগে আরেকটি বিয়ে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকেই নিপার বর্তমান স্বামীর সঙ্গে তার আগের স্বামীর বিরোধ চলে আসছিল। এদিকে প্রথম স্বামীর চাচাতো ভাই মহাদেবপুর গ্রামের পিয়াস ও পশ্চিম লক্ষ্মীপুর গ্রামের রাজিব মাদক ব্যবসায়ী। তাদের সঙ্গে ওই এএসআইয়ের সখ্য আছে।
দালাল বাজার ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মুরাদ হোসেন বলেন, বাবু খুব শান্ত, কর্মঠ যুবক। ঘটনার আগে বিয়েবাড়িতে একসঙ্গে ছিলাম। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি তাকে মারধর করা হচ্ছে। তার গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি ও পরনে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট ছিল। একপর্যায়ে পিয়াস পুলিশের উপস্থিতিতে কাদামাটিতে পড়ে থাকা তিনটি ইয়াবা আমাদের দেখায়। পরে সেগুলো তুলে বাবুর হাতে গুঁজে দেয়।
গত ১৫ আগস্ট চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ কলেজগেটে এক ব্যক্তির পকেটে মাদক ‘ঢুকিয়ে ফাঁসানোর’ চেষ্টার সময় জনতার ধাওয়া খেয়ে পালানোর অভিযোগ রয়েছে পুলিশের এক এসআইয়ের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী ফরিদগঞ্জ পূর্ব কাছিয়াড়া গ্রামের মজিবুর রহমান জানান, তিনি স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। কলেজগেট এলাকায় আসার পর থানার এসআই ফারুক আহমেদ তার পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলেনÑ ‘তোর পকেটে মাদক আছে’। এর পর মারধর শুরু করেন তাকে। এ সময় তার চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসে। অবস্থা বেগতিক দেখে সেখান থেকে পালিয়ে যান এসআই ফারুক।
দৈনিক আমাদের সময়
পাঠকের মতামত