সামুদ্রিক শৈবালের নির্যাস থেকে অধিক গুণমানসম্পন্ন ও পরিবেশবান্ধব সাবান এবং ক্যান্ডি উদ্ভাবনে সফলতা পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার প্রেক্ষাপটে দেশের মানুষের মধ্যে সামুদ্রিক শৈবাল গ্রহণের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে শৈবালের নির্যাস থেকে তৈরি করা হয়েছে সাবান এবং দুই ধরনের ক্যান্ডি। শৈবালের নির্যাস দিয়ে তৈরি এই পণ্যগুলো প্রচলিত পণ্যের তুলনায় অধিক গুণমানসম্পন্ন, স্বাস্থ্যসম্মত এবং পরিবেশবান্ধব।
গবেষক দলের প্রধান বাকৃবির ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফাতেমা হক শিখা। তার নেতৃত্বে ঐ গবেষণায় কাজ করেন একই বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম নওশাদ আলম, ড. মো. ইসমাইল হোসেন, সহযোগী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মেহেদী হাসান, সহকারী অধ্যাপক মোছা. প্রিয়াংকা জাহান এবং লেকচারার নাফিস তাসনিম বিনতিসহ স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীরা।
খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মানবখাদ্য ও বিভিন্ন পণ্যে সামুদ্রিক শৈবালের প্রয়োগ বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। সামুদ্রিক শৈবালে প্রয়োজনীয় ভিটামিন, ট্রেস উপাদান, আমিষ, লিপিড, পলিস্যাকারাইড, এনজাইম এবং খনিজ উপাদানের ঘনত্ব স্থলজ খাদ্যদ্রব্যের তুলনায় অনেক বেশি। ফুকোইডান, ফাইকোবিলিপ্রোটিন, ৪-ক্যারোটিন, লুটেইন, ফুকোস্টেরল, টেরপেনয়েডস, অ্যানথেরাক্সানথিন, ভিটামিন এবং অক্সিনথিনসহ বিভিন্ন অসাধারণ বায়োঅ্যাকটিভ যৌগের উপস্থিতির কারণে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্য সামুদ্রিক শৈবাল থেকে খুব সহজেই তৈরি করা যেতে পারে।
সামুদ্রিক শৈবালের নির্যাস থেকে উদ্ভাবিত সাবান সম্পর্কে প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. ফাতেমা হক শিখা জানান, গ্র্যাসিলারিয়া প্রজাতির শৈবালের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্যের জন্য এই শৈবাল সাবান তৈরির জন্য উপযোগী। প্রচলিত রাসায়নিক সাবানের প্রাকৃতিক বিকল্প হিসেবে এটি ব্যবহার করা যাবে। বাণিজ্যিক সাবানের কৃত্রিম উপাদানগুলি অ্যালার্জি এবং সংবেদনশীলতাসহ বিভিন্ন বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। সামুদ্রিক শৈবাল দিয়ে তৈরি সাবান সম্পূর্ণ জৈবিক হওয়ায় এতে বিপরীত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। ত্বকের কোনো প্রকার ক্ষতিসাধন ছাড়াই ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য জীবাণু ধ্বংসের ক্ষেত্রে এই সাবান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. ফাতেমা জানান, সামুদ্রিক শৈবালে উপস্থিত বায়োঅ্যাকটিভ যৌগগুলি বর্তমানে নিউরো-ডিজেনারেটিভ রোগ (আলজেইমারস এবং পারকিনসনস), গ্যাস্ট্রিক আলসার, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, ক্রনিক ফ্যাটিগ সিনড্রোম (সিএফএস), কার্ডিও-ভাস্কুলার রোগ, চক্ষুসংক্রান্ত রোগ ইত্যাদির চিকিত্সায় ব্যবহূত হচ্ছে। গ্র্যাসিলারিয়া প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল দিয়ে তৈরিকৃত ক্যান্ডি বাণিজ্যিক ক্যান্ডির একটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প। এই ক্যান্ডিগুলোর মাধ্যমে শিশুরা সামুদ্রিক শৈবালের পুষ্টি পাবে। এই প্রজাতিতে প্রায় ১৮ শতাংশ আমিষ, ৮ দশমিক ৯ শতাংশ ফ্যাটসহ আয়রণ, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-সি, ফসফরাস, ম্যাংগানিজ ইত্যাদি উপাদান বিদ্যমান। শৈবাল দিয়ে তৈরি করা এই ক্যান্ডিতে ক্ষতিকর কোনো উপাদান না থাকার ফলে শিশুরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা কম। শুধু শিশুরা নয়, যে কোনো বয়সের মানুষের কাছে এই ক্যান্ডি উপভোগ্য হবে।
এছাড়াও সিলভার কার্প মাছের উপযোগিতা বৃদ্ধির জন্য সয়াবিনের আমিষ সহযোগে ফিশ ফিংগার উদ্ভাবনের গবেষণায় প্রাপ্ত পণ্য নিয়েও আলোচনা করেন অধ্যাপক ড. ফাতেমা। এ সময় তিনি জানান, সিলভার কার্প অনেক পুষ্টিগুণসম্পন্ন একটি মাছ। প্রতি ১০০ গ্রাম সিলভার কার্প মাছে রয়েছে প্রায় ২০ গ্রাম আমিষ, ১ দশমিক ১ গ্রাম ফ্যাট, ১১ গ্রাম আয়রণ, ৩৫০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৩৮২ মিলিগ্রাম ফসফরাস। ১৩৮ গ্রাম সিলভার কার্প মাছ থেকে প্রায় ১০০ কিলোক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। এছাড়াও এতে রয়েছে ভিটামিন বি১২ ও ভিটামিন ডি। অধিক কাঁটাযুক্ত হওয়ায় এ মাছটিকে অনেকেই খাদ্যাভ্যাস থেকে পরিহার করে। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য এই মাছ থেকে ‘ফিস ফিংগার’-এর মতো ভ্যালু অ্যাডেড প্রোডাক্ট তৈরি করা হয়েছে। এতে করে নতুন রূপে মাছের পুষ্টি সবার কাছে পৌঁছে যাবে
পাঠকের মতামত