বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে কয়েক দিন ধরে ব্যাপক গোলাগুলি হচ্ছে। গুলির বিকট শব্দে কাঁপছে এপারও। তাতে আতঙ্কে কোনারপাড়ার পার্শ্ববর্তী শূন্যরেখার (নো ম্যানস ল্যান্ড) আশ্রয়শিবিরে থাকা চার হাজারের বেশি রোহিঙ্গা এবং ঘুমধুম ইউনিয়নের কয়েক হাজার বাংলাদেশি। ওপারের গোলাগুলির ঘটনা নজরদারিতে রাখছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, আজ সোমবার সকাল সাতটা থেকে বিকট শব্দে মর্টারশেল ও ভারী অস্ত্রের গুলির শব্দ এপারে শোনা যাচ্ছে। মিয়ানমার সীমান্তের দেড়–দুই কিলোমিটার দূরের পাহাড়ে গিয়ে পড়ছে এক একটা শেল ও গুলি। থেমে থেমে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে গোলাগুলি, তা–ও ১০-১২ দিন ধরে। শূন্যরেখার দিকে কাউকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে ৬২১টি পরিবারে ৪ হাজার ২০০ জন রোহিঙ্গা আছে। গোলাগুলির শব্দে তারা বেশ আতঙ্কে।
ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, বিভিন্ন সূত্রে তিনি জানতে পেরেছেন, মিয়ানমার সীমান্তে (রাখাইন রাজ্যের তুমব্রু এলাকায়) সশস্ত্র বিদ্রোহী আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ চলছে কয়েক দিন ধরে। সংঘর্ষে গুলির সঙ্গে মর্টারশেলও ব্যবহার হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের সেবা কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
ঘুমধুম পুলিশ তদন্ত ফাঁড়ির ইনচার্জ ও পুলিশ পরিদর্শক সোহাগ রানা প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিন ধরে মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলি হচ্ছে। মর্টার শেলসহ গুলির শব্দ কানে বাজলেও বাস্তবে সেখানে কী হচ্ছে, বলা মুশকিল। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সীমান্তে ওপারের গুলি কিংবা মর্টারশেল এসে পড়েনি।
শূন্যরেখায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নজরদারিতে কাঁটাতারের বাইরে পাহাড়চূড়ায় মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) একাধিক চৌকি স্থাপন করেছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর রাখাইন রাজ্যে সে দেশের সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেয় ৮ লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে আসে আরও কয়েক লাখ। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ।
সে সময় ছয় হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের কোনারপাড়া খালের দক্ষিণে শূন্যরেখায় বসতি শুরু করে। ওই আশ্রয়শিবিরে কয়েক গজ দূরত্বে মিয়ানমার সীমান্ত কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। শূন্যরেখায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নজরদারিতে কাঁটাতারের বাইরে পাহাড়চূড়ায় মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) একাধিক চৌকি স্থাপন করেছে।
এই সীমান্ত এলাকায় নজরদারি করে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়ন। মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলির কারণ জানতে নানাভাবে চেষ্টা করেও ৩৪ বিজিবির বক্তব্য পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে বিজিবি সদর দপ্তরের পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়েজুর রহমান দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার বিস্তারিত জেনে তিনি জানাবেন। পরে নানাভাবে চেষ্টা করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা প্রথম আলোকে বলেন, শূন্যরেখার ওই আশ্রয়শিবির দেখাশোনা করে বিজিবি। সেখানকার চার হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে খাদ্যসহায়তা দিচ্ছে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরসি)। শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে সরকারি-বেসরকারি সেবা কার্যক্রম পরিচালনা হয় না।
গুলির শব্দে ঘুম হারাম
শুরুতে শূন্যরেখার এই শিবিরে ছিল ১ হাজার ৩২১ পরিবারের ৬ হাজার ২২ জন রোহিঙ্গা। যাদের বাড়ি আশ্রয়শিবিরের পেছনে দেড় থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের রাখাইন রাজ্যের ১২টি গ্রামে। বর্তমানে শিবিরে আছে ৬২১ পরিবারে ৪ হাজার ২০০ জন রোহিঙ্গা। শূন্যরেখার কোনারপাড়া আশ্রয়শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ (৫৫) মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গুলির শব্দে ঘুমাতে পারছি না। মনে হচ্ছে ক্যাম্পেই গুলি ছোড়া হচ্ছে। সকাল ৬-৭টার দিকে শুরু হয় গোলাগুলি, থেমে থেমে গুলিবর্ষণ চলে গভীর রাত পর্যন্ত।’
এই কথা বলার সময়ই দুইবার গুলির শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। দিল মোহাম্মদ বলেন, শূন্যরেখা থেকে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে দিতে ২০১৮ সালের ২ মার্চ তুমব্রু সীমান্তে সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছিল মিয়ানমার। তখন প্রতিদিন গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যেত। মাইকিং করে শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে বলা হতো। নইলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে বলে হুমকি দিত। বিজিবির তৎপরতায় তখন সেনা সমাবেশ সরিয়ে নিলেও একাধিক চৌকি স্থাপন করে রোহিঙ্গাদের কঠোর নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। দিল মোহাম্মদ বলেন, ‘দুই মাসের জন্য আমরা এই শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে এসেছিলাম। এখন পাঁচ বছর কেটে গেল রাখাইনের জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।’
দিল মোহাম্মদের (৫০) বাড়ি রাখাইন রাজ্যের মেদি পাড়ায়। ১০ বছরের বেশি সময় তিনি বিজিপির সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে চলা পতাকা বৈঠকে তিনি দোভাষীর কাজ করতেন। অথচ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের রোহিঙ্গা ঢলের সঙ্গে তাঁকেও জন্মভিটা ছেড়ে সপরিবার পালাতে হয়। সেই থেকে স্ত্রী-চার সন্তান নিয়ে তিনিও শূন্যরেখার বাসিন্দা। নেতৃত্ব দিচ্ছেন ৪ হাজার ২০০ জন রোহিঙ্গার।
সমস্যা নিয়ে শূন্যরেখায় বসবাস
ঘুমধুমের পাথরকাটা খালের ওপারে শূন্যরেখার আশ্রয়শিবির। এর পেছনে লাগোয়া মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার পাশে মিয়ানমার সীমান্তের উঁচু–নিচু পাহাড়। পাহাড়ের রাস্তায় ভারী অস্ত্র হাতে জওয়ানদের টহলের দৃশ্য এপার থেকে দেখা যায়।
মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘুমধুম ইউনিয়নের সীমান্ত প্রায় ৬৫ কিলোমিটারের। ঘুমধুম ইউনিয়নের লোকসংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের ত্রাণসহায়তা দিচ্ছে আইসিআরসি। ১৫ দিন অন্তর রোহিঙ্গাদের ত্রাণসহায়তা দেওয়া হয়। ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা কমিটির সেক্রেটারি আরিফুর রহমান বলেন, ১৫ দিনের সহায়তা হিসেবে প্রতি পরিবার পাচ্ছে ২৫ কেজি চাল, ৩ লিটার তেল, ৩ কেজি ডাল, আধা কেজি লবণ, আড়াই কেজি ছোলা, ৩ কেজি চিনি ইত্যাদি। তবে সবজি-তরকারি, জ্বালানি (কাঠ, গ্যাস সিলিন্ডার) সরবরাহ করা হয় না। ঘুমধুম বাজার থেকে এসব সংগ্রহ করতে হয়।
রোহিঙ্গা শরণার্থী নুরুল আমিন ও দিল আরা বলেন, পাঁচ বছর আগের তৈরি ঝুপরি ঘরে অমানবিক জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের। আইসিআরসি দুটি ড্রামে পানি সরবরাহ করে। খাল পার হয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে গিয়ে ড্রামের পানি আনতে হয়। অসুখ-বিসুখ হলে খালের ওপারে অস্থায়ী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হয়। সেখানে সপ্তাহের পাঁচ দিন স্বাস্থ্যসেবা চলে। শূন্যরেখায় এই আশ্রয়শিবিরে এনজিও কিংবা ব্যক্তিবিশেষের সাহায্যও পাওয়া যায় না। উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিশুরা পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে, মেয়েরা পাচ্ছে নানা সুযোগ-সুবিধা। বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার টয়লেট ও গোসলের ব্যবস্থাসহ বিনোদনের কিছুই নেই এখানে। এ পর্যন্ত শূন্যরেখার কেউ করোনা টিকাও পায়নি।
সৌজন্যে : প্রথম আলো