আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন লঙ্গন করে পূঁতা স্থলমাইনে মঙ্গলবার বিকেলে আহত কাদের হোসেন এ দেশের নাগরিক নয়। সে রোহিঙ্গা। তার পরিবার-পরিজন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শরনার্থী। বর্তমানে সে চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে।
বুধবার (৫ অক্টোবর) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রায় ২ ঘন্টা সীমান্তের চেরারমাঠ, দক্ষিণ চাকঢালা এবং ৪৩ ও ৪৪ নম্বর পিলারের আশপাশের গ্রাম সমূহে অনুসন্ধানের পর এ তথ্য পান এ প্রতিবেদক।
অনুসন্ধানকালে স্থানীয় ৬ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার ফরিদুল আলম বলেন, ওপারে মিয়ানমারে দীর্ঘ দেড় মাস ধরে যুদ্ধ চলছে। সে দেশের সরকার বাহিনী ও বিদ্রোহী বাহিনীর মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে। তারা যুদ্ধ বিমান, হেলিকপ্টার, মর্টারশেল ও একে-৪৭ এর ব্যবহার করে। যে সব অস্ত্র ব্যবহারের আওয়াজে সীমান্তের বাংলাদেশী লোকজন আতংকিত। এরই মাঝে মঙ্গলবার (৪ অক্টোবর) দুপুর ৩ টায় স্থলমাইন বিষ্ফোরণে আহত হয় রোহিঙ্গা নেতা সেই কাদের হোসেন।
এক প্রশ্নের জবাবে মেম্বার ফরিদ জানান কাদের হোসেন বাংলাদেশী নাগরিক নয়। ভোটার তালিকায় তার নাম থাকার প্রশ্নই আসে না। সে রোহিঙ্গা। তার পেশা কি তিনি বলতে পারেন না। তবে তাকে সবাই চেনে।
দক্ষিণ চাকঢালার বসিন্দা ব্যবসায়ী খলিল জানান, আসলে এ কাদের সাহেব একজন ভালো মানুষ। সে মানুষের প্রিয় পাত্র। কিন্ত তার বাড়ি সম্পর্কে তিনি কিছুই বলতে পারে না। সে বর্তমানে চট্টগ্রামে চিকিৎসাধীন বলে গ্রামবাসী শুনেছেন।
সীমান্তের একাধিক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে জানান, কাদের হোসেন একজন রোহিঙ্গা নেতা। তিনি যেখানে স্থলমাইনে আহত হয়েছে সে স্থানের নাম চেক্কেন নাই বা পুরান মাইজ্জ্বার সীমান্ত গেইট এলাকা। যেটি সীমান্ত পিলার ৪৩ ও ৪৪ এর মাঝামাঝি এলাকায় অবস্থিত। তবে ৪৪ নম্বর পিলারের কাছাকাছি। যার বাংলাদেশ অংশ দক্ষিণ চাকঢালার চেরারকূলের নূরজাহান ও আবদুল্লাহ বাপের ঘোনার আগা।
তারা আরো বলেন, মিয়ানমারের সরকারী বাহিনী সীমান্তের চৌকি ছেড়ে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের ব্যাটালিয়নে চলে গেলে আরকান আর্মি ও তাদের সহযোগীরা সীমান্ত চৌকি গুলো দখলে নিয়ে নেয়। কিন্তু তাদের বসানো মাইনগুলো তখনো অক্ষত ছিলো। যাতে নো-ম্যান্স ল্যান্ডে লোকজন আহত হচ্ছিলো।
সীমান্তের প্রবীণ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি এ প্রতিবেদককে বলেন, মিয়ানমার সেনারা আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন লঙ্গন করে বিগত ২০১৭ সাল থেকে স্থলমাইন পূঁতে রেখেছিলো। যা নিষ্কৃয় হয় নি। সে গুলো অক্ষত ছিলো। মঙ্গলবার দুপুরে সীমান্তের ৪৪ পিলার এলাকার পুরান মাইজ্জার পাশের গেইট দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে আহত হন রোহিঙ্গা কাদের ।
তারা আরো বলেন, বর্তমানে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। আর সীমান্তজুড়ে বসানো হয় স্থলমাইন। বিশেষ করে সীমান্তের তুমব্রু হেডম্যান পাড়ার সন্নিকটস্থ ৩৫ নম্বর পিলার থেকে টাংগারা ৫৪ নম্বর পিলার পর্যন্ত প্রায় ৬০ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকায় স্থলমাইন
পুঁতে রাখে মিয়ানমারে সেনারা। যা এতো দিন মাটির ভেতর সক্রিয় ছিল। নিষ্কৃয় করা হয় নি। যার একটির বিষ্ফোরণে কাদের হোসেন আহত হয়। তার ডান পা উড়ে যায়। চোখে আঘাত লাগে।
সীমান্ত বিষয়ে অভিজ্ঞ একাধিক সচেতন ব্যক্তি জানান, মিয়ানমার ২০১৭ সালে তৃতীয় দফা স্থল মাইন বসালে সরকার পত্র মারফৎ প্রতিবাদ জানান। প্রথমে তারা অস্বীকার করলেও পরে তারা পতাকা বৈঠকে বসতে সম্মত হন। যা ২০১৭ সালের ডিসেস্বর মাসের শুরুতে তারা অধিকাংশ মাইন তুলে নেয়। যা ডিসেম্বরের শেষ পক্ষে দীর্ঘ ৬০ কিলোমিটার এলাকায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার উভয় দেশের স্থলমাইন বিশেষজ্ঞরা মাইন অপসারণ হলো কি-না সরেজমিন যাচাই করেন। সত্যতা পান।
এরপর উভয় দেশের প্রতিনিধিরা সম্মত হন, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্গন করে নতুন করে কোন স্থলমাইন বসাবে না । তখন পতাকা বৈঠক হয় দু’ দফা।
এর আগে ২০০৪ সালে এবং ২০১২ সালেও অনুরূপ ঘটনার পর পতাকা বৈঠকে উভয় দেশ সীমান্ত আইন মেনে চলবে বলে সম্মত হয়েছিল।
দোছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব হাবিবুল্লাহ বলেন, কেননা সে সব স্থলমাইনে তার ইউনিয়নের পাইনছড়ি গ্রামের ৫২ পিলার
সন্নিকটে স্থলমাইন বিষ্ফোরণে নায়েক মিজান মারা যান। ২০১৮ সালে ৩৫ পিলার সন্নিকটে এক পুলিশ সদস্য মারা যান সে পয়েন্টে আহত হয় অনেকে। এভাবে পুরো সীমান্ত জুড়ে নো-ম্যান্স ল্যান্ডে মিয়ানমার কতৃর্ক বসানো স্থল মাইনে কয়েক শত বাংলাদেশী, রোহিঙ্গা ও চেরাকারবারী আহত হয়। তাদের বেশ ক’জন মারাও যায় পরে।
সীমান্তের অধিবাসী ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব খাইরুল বশর বলেন, মিয়ামমার ২০১৭ সালে মাইন বসিয়ে ডিসেম্বরে অপসারণ করলেও পরের বছর (২০১৮ সালে) পুণরায় এ মাইন বসিয়ে রাখে। তুমব্রু বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না কারার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, গত দেড়মাস কাল ধরে মিয়ানমার বাহিনী ও আরকান বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলির মাঝেও বিদ্রোহীদের ঠেকাতে নতুন কিছু স্থানে মাইন বসান মিয়ানমার সেনারা।
সে সব মাইনের ১ টি বিষ্ফোরণ হলে গত ১৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে তুমব্রু হেডম্যান পাড়ার অন্ন্যায় তংচঙ্গার (২৮) ডান পা উড়ে যায়। এর ২ সপ্তাহ পর মিয়ানমার অভ্যন্তরে ১ রোহিঙ্গা মারা যায় অপরজন আহত হয়। আর গত পরশু মঙ্গলবার (৪ অক্টোবর) নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের চেরারমাঠ নুরজাহান বাপের ঘেনার আগায় ৪৪ পিলার সন্নিকটে কাদের হোসেন নামের এক রোহিঙ্গা নেতার ডান পা উড়ে যায়। এক চোখ ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
এ বিষয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল আবছার ইমন বলেন, মঙ্গলবার বিকেলে চেরারমাঠের বিপরীতে নো-ম্যান্স ল্যান্ডে স্থলমাইনে আহত কাদের হোসেন একজন রোহিঙ্গা নাগরিক বলে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন। এলাকার লোকজন জানিয়েছেন তিনি ওপারের বাসিন্দা।
সে কারণে সে বাংলাদেশী ভোটার হওয়ার প্রশ্নই আসে না। সে কক্সবাজারের উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশ্রিত রোহিঙ্গা।
তিনি মাইন বিষয়ে আরো বলেন, মিয়ানমার সেনা ও সীমান্তরক্ষীর বসানো স্থলমাইনে লোকজন আহত হচ্ছে শুনে সীমান্তের লোকজন আতংকে আছে। তবে তাদেরকে সীমান্তে না যাওয়ার জন্যে ১১ বিজিবি কতৃর্পক্ষ নানাভাবে এলার্ড জারী করেছেন।
১১ বিজিবি প্রতিটি সংযোগ সড়ক ও চলাচল পথে সীমান্তের কাছাকাছি না যেতে সর্বসাধারণকে নিষেধ করে সাইনবোর্ডও টাংগিয়েছেন, অসর্তকভাবে যেন কেউ সীমান্তের কাছাকাছি না যান। মাইনের কবলে না পড়েন।
পাঠকের মতামত