গত কয়েক দিন ধরেই উত্তেজনা বিরাজ করছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তে। এ পরিস্থিতিতে দেশের সব বাহিনীর সঙ্গে গতকাল রোববার উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বৈঠকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি রাখতে বলা হলেও কূটনৈতিকভাবেই সমাধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা।
গত তিন দিনে সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমার বাহিনীর ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে নো ম্যান্স ল্যান্ডে এক রোহিঙ্গা তরুণ নিহত এবং আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। এ ছাড়া মিয়ানমারের পুঁতে রাখা মাইনে আহত হয়েছেন এক বাংলাদেশি। প্রতিদিনই সীমান্তের এপার থেকে থেমে থেমে শোনা যাচ্ছে গুলি ও মর্টারের শব্দ। কখনও এসে পড়ছে গুলি ও গোলা।
এ অবস্থায় গতকাল দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ও মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম। বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নৌবাহিনী, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), কোস্টগার্ড, পুলিশ, এনএসআই, ডিজিএফআইসহ বাংলাদেশের সব বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে মো. খুরশেদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা সবাইকে নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেছি। বাংলাদেশের যত বাহিনী রয়েছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও কোস্টগার্ডকে বলে দিয়েছি সীমান্তে সজাগ থাকতে। নতুন করে সৈন্য পুনর্বহাল যেখানে যতটুকু লাগে, সেখানে করা হবে। যাতে সাগর দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়েও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে।
বৈঠক সূত্র জানায়, মিয়ানমার থেকে ক্রমাগত মর্টার শেল ও গোলা এসে পড়াকে আর দুর্ঘটনা হিসেবে দেখছে না বাংলাদেশ। এটাকে এক ধরনের উস্কানি হিসেবে দেখছে। সীমান্ত এলাকায় সাধারণ মানুষ মারা যাওয়ায় বিষয়টি উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে ঢাকার জন্য। বিশেষ করে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সামরিক বাহিনীগুলো বৈঠকে শক্তি প্রদর্শনের পক্ষে মত দিয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে সংকট সমাধানে কাজ করবে। তবে বাহিনীগুলোকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি রাখতে বলা হয়েছে।
বৈঠকে উপস্থিত এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে সমকালকে বলেন, মিয়ানমার যা করছে তা স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধের উস্কানি। তবে সেই ফাঁদে পা দেবে না বাংলাদেশ। তারা মূলত অভ্যন্তরীণভাবে তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে একটি যুদ্ধ চাচ্ছে। তবে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা এসেছে ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে শান্তি বজায় রাখতে। আর কূটনৈতিক চ্যানেলে এর সমাধান করতে।
মিয়ানমার থেকে আরও গোলা ও মর্টার শেল এসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার প্রশাসকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, কোনো আতঙ্ক না ছড়িয়ে সীমান্ত এলাকা থেকে জনগণকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে। কোনোভাবেই যাতে সাধারণের মাঝে কোনো আতঙ্ক না ছড়ায়। সেই সঙ্গে রামুসহ পার্বত্য অঞ্চলে যত সেনানিবাস রয়েছে, তাদের উচ্চ মাত্রায় সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। যাতে কম সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, একের পর এক আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে যাচ্ছে মিয়ানমার। একাধিকবার আকাশসীমা লঙ্ঘন, বাংলাদেশের ভূমিতে মর্টার শেল, গোলাসহ গুলি এসে পড়ছে। মিয়ানমারের আকাশসীমা লঙ্ঘনের বিষয়টি বাংলাদেশ দুর্ঘটনা হিসেবে দেখে আসছিল। কারণ, সীমান্ত সরল রেখায় নেই, আঁকাবাঁকা। ফলে আকাশসীমা লঙ্ঘন হয়েছে। মর্টার শেল বা গোলা ছোড়ার বিষয়টিও দুর্ঘটনা হিসেবে দেখছিল। ভুল করে হয়তো দু-একটা এসে পড়েছে। কিন্তু একই ভুল যখন বারবার হয়, তখন সেটিকে আমলে নিতে হয়। আর বাংলাদেশের ভেতরে যখন মাইন পুঁতে রাখার বিষয়টি আসে, তখন শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, মর্টার শেল বা গোলা যখন ভুল করে বাংলাদেশে এসে পড়ে, তখন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আসে। কারণ, এ ধরনের মর্টার শেল বা গোলা ছোড়ার সময় প্রতি ইঞ্চির হিসাব করে ছোড়া হয়। এ নিয়ে সতর্ক করে আসার পরও যখন বাংলাদেশের ওপর তাদের মর্টার শেল বা গোলা এসে পড়ছে, তা ইচ্ছাকৃত হিসেবেই বিবেচনা করছে বাংলাদেশ। কারণ বাহিনীর এ সদস্যরা এ ধরনের অস্ত্র চালানোর বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
কূটনীতিকরা বলেন, মিয়ানমার যুদ্ধ চাইলেই তাতে জড়ানো উচিত হবে না বাংলাদেশের। কারণ, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন প্রবৃদ্ধিতে রয়েছে। আর করোনা ও ইউক্রেন-রাশিয়া নিয়ে বিশ্ব পরিস্থিতিতে এক প্রকার সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে যুদ্ধে জড়িয়ে গেলে অর্থনীতি আরও খারাপের দিকে যাবে। আর বাংলাদেশের অর্থনীতির এ মুহূর্তে সেই শক্তি নেই যে যুদ্ধে জড়াবে। ফলে কূটনৈতিকভাবেই সংকট সমাধানে চেষ্টা চালাতে হবে। সেই সঙ্গে একটি শক্ত বার্তা মিয়ানমারকে দিতে হবে- প্রয়োজনে শক্তি প্রদর্শন করবে বাংলাদেশ।
এর আগে সকালে মিয়ানমারের ঢাকার রাষ্ট্রদূত উ আং কিয়াউ ময়েকে তলব করা হয়। তলব করে মিয়ানমারের কর্মকাণ্ডের জন্য কড়া প্রতিবাদ দেওয়ার পাশাপাশি এগুলো বন্ধ নিশ্চিতে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মিয়ানমারের দূত পৌঁছালে তাঁকে ১৫ মিনিটের মতো বসিয়ে রাখা হয়। এরপর মিয়ানমার অনুবিভাগের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক নাজমুল হুদা নোট ভারবালের মাধ্যমে বাংলাদেশের কড়া প্রতিবাদ পত্র হস্তান্তর করেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এড়াতে দৌড়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ত্যাগ করেন মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত।
নাম না প্রকাশের শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমারের দূতকে শনিবার তলব করা হয়েছিল। তবে তিনি অসুস্থ থাকায় রোববার এসেছেন। বৈঠকে তাঁকে চা-বিস্কুট কোনো কিছুই খেতে দেওয়া হয়নি।
কী ধরনের অসুস্থতা মিয়ানমারের দূতের জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁর মূলত দাঁতে ব্যথা। তাই তিনি বেশি কথা বলতে পারেননি। তবে বৈঠকে তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি নেপিদোকে জানাবেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বরাবরই বাংলাদেশের কাছে অভিযোগ করে আসছে, আরাকান আর্মিসহ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে ঢুকে সহিংসতা চালিয়ে আসছে। যা মিয়ানমারের সার্বভৌমের জন্য হুমকি। বাংলাদেশ যখনই মিয়ানমারকে তার কর্মকাণ্ডের জন্য প্রতিবাদ জানিয়েছে, তখনই মিয়ানমার এ ব্যাখ্যা হাজির করছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। ফলে যখন তারা পালিয়ে আবারও বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়, তখন গোলাগুলিতে কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে।
মিয়ানমারের দূতকে তলব নিয়ে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব সাংবাদিকদের বলেন, মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে আমরা প্রতিবাদলিপি দিয়েছি। সীমান্তে যেসব ঘটনা ঘটছে, সেগুলোর পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়। আমরা এটাও বলেছি, এটা আপনাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। সেটা কীভাব সমাধান করবে তা মিয়ানমারকে চিন্তা করতে হবে। কিন্তু মিয়ানমারের গোলা যাতে আমাদের ভূখণ্ডে না আসে সেটা দেখা তাদের দায়িত্ব। বাংলাদেশ দায়িত্বশীল শান্তিকামী রাষ্ট্র। আমরা ধৈর্যের সঙ্গে অনেক দিন ধরে এসব সহ্য করে যাচ্ছি। আমরা বলেছি, আপনাদের সমস্যার সমাধান করুন। যাতে করে আমাদের এখানে কোনো রক্তপাত না হয়, প্রাণ না যায়।
তিনি আরও বলেন, আপনারা হয়তো বলবেন, আপনারা প্রতিবারই প্রতিবাদ লিপি দেয়, কিন্তু কিছু হয় না। কিন্তু এটাতে আমাদের আসলেই কিছু করার নেই। কারণ আমরা তো একটা দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিবেশীকে যা নিয়ম অনুযায়ী করা যায়, সেটাই করছি। এখানে আমরা যে বক্তব্য দিয়েছি তাতে কোনো রকম দুর্বলতা বা নতজানু বলে থাকে, সে ধরনের কোনো কথাই নেই। আমরা বরং শক্ত অবস্থান থেকে প্রতিবাদ জানিয়েছি। আমরা চেষ্টা করছি আসিয়ান দেশের রাষ্ট্রদূতদের বিস্তারিত জানাতে। যাতে আমরা আসিয়ান দেশগুলোকে বলতে পারি, বারবার একই অবস্থা শুনে গিয়েও তারা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না, এটা প্রতিবেশী হিসেবে খুব দুঃখজনক। আমরা এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না।
তলব করা হলে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত কী জানিয়েছেন জানতে চাইলে মো. খুরশেদ আলম বলেন, রাষ্ট্রদূতের তেমন কোনো জবাব সেভাবে পাওয়া যায়নি। রাষ্ট্রদূত বলেছেন, এই তথ্যগুলো নেপিদোতে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবেন। নেপিদো যাতে এ ব্যাপারে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারে। আমরা আগেও তাদের বলেছি, এবারও রাষ্ট্রদূত মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, যে কথাগুলো আমরা বলেছি, মর্টার শেল পড়া, প্রাণহানিসহ কয়েকজন আহত হওয়ার কথা, তিনি না করেননি একটিও- যে না এগুলো হয়নি। কিন্তু তাদের বক্তব্য আছে, এগুলো আরাকান আর্মির গোলাগুলিতে হতে পারে। আমাদের বক্তব্য হলো, আপনাদের দেশের ভেতর থেকে যা কিছু আসুক না কেন, এটা আপনাদের দায়িত্ব। এটা আপনারা দেখবেন। আপনাদের ওপাশ থেকে যেন কিছু না আসে সেটা আপনারা নিশ্চিত করবেন। এর জন্য যা কিছু দরকার, তা নিশ্চিতে সে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী মোতায়েন করেছে কিনা এ বিষয়ে সাবেক এই রিয়ার অ্যাডমিরাল বলেন, বিজিবি ও কোস্টগার্ড ছাড়া আর কোনো বাহিনী বাংলাদেশের সীমান্তে নেই। আমরা সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের কথা এখনই ভাবছি না। সুত্র; সমকাল